হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা:
হরপ্পা সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক। উৎখননের ফলে হরপ্পা, মহেন-জো-দারো, রূপার, কালিবঙ্গান, লোখাল, ধোলাবিরা সকল স্থানেই নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এই নগরগুলির গঠনরীতি ছিল প্রায় একইরকম। নগর পরিকল্পনা ছিল অনেকটা দাবার বোর্ডের মতো সাজানো।
• রাস্তা:
মহেন-জো-দারো, হরপ্পা, লোথাল, কালিবঙ্গানে দেখা যায় যে, রাস্তাগুলি ছিল সোজা; উত্তর থেকে দক্ষিণে বা পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। একদিকের রাস্তার সঙ্গে অন্যদিকের রাস্তা সমকোণে সংযুক্ত। বড়ো রাস্তার পাশ থেকে গলিগুলি বের হয়ে গেছে। বড়ো রাস্তাগুলিও 9 থেকে 34 ফুট চওড়া এবং গাড়ি চলাচলের উপযোগী গলিগুলিতে পানীয় জলের কুপ খোঁড়া হত। বড়ো রাস্তায় Lamp Post বা রাস্তার বাতি থাকত।
• গৃহনির্মাণ পদ্ধতি:
রাস্তার ওপর সারিবদ্ধভাবে গৃহগুলি তৈরি হত। গলিতেও গৃহনির্মাণ করা হত। রাস্তা অবরোধ করে গৃহনির্মাণ করা যেত না। সাধারণত পোড়া ইটের বাড়ি তৈরি হত। বৃহৎ প্রাসাদ, বাড়ি, বাসগৃহ, স্নানাগার, দুর্গ-এইভাবে শ্রেণিবিভাগ করা যায়। বাসগৃহগুলি বিভিন্ন আকৃতির ছিল। দু-কামরাযুক্ত ছোটো গৃহ থেকে তিরিশ কামরাযুক্ত বিরাট প্রাসাদ হরপ্পা সংস্কৃতিতে দেখা যায়। কোনো কোনো বাড়িতে কয়েকটি তলা ছিল। ওপরের তলায় যাওয়ার জন্য মজবুত সিঁড়ি ছিল। অধিকাংশ বাড়িতে একটি আঙিনা, ও থেকে এটি কক্ষ, একটি স্নানাগার ও একটি পাকশালা থাকত। কোনো-কোনো বাড়িতে জল সরবরাহের জন্য নিজস্ব কুপ থাকত।
বাড়িগুলির সামনের দিকে অর্থাৎ রাস্তার দিকে কোনো দরজা, জানালা থাকত না। বাড়িতে ব্যবহৃত ইটগুলি বেশ বড়ো আকারের ও একই মাপের ছিল।
• দুর্গ:
হরপ্পা ও মহেন-জো-দারোর পশ্চিমের একটি অংশ ছিল উঁচু। নগরের এই উঁচু এলাকা ‘সিটাডেল’ নামে পরিচিত। এই সিটাডেলগুলি ছিল আয়তাকার এবং প্রাকার দিয়ে ঘেরা থাকত। এই উঁচু এলাকায় নগরের দুর্গ থাকত। সম্ভবত এই দুর্গে শাসকশ্রেণির লোকেরা থাকত। হরপ্পার দুর্গে বাইরের দেয়াল ছিল 13 মিটার চওড়া। এই দেয়াল ছিল কাঁচা ইটের তৈরি। দেয়ালের কোণে কোণে গম্বুজ বা বুরুজ ছিল। প্রাচীরের ওপর মাঝে মাঝে বুরুজ স্থাপন করা ছিল।
• শস্যাগার:
হরয়া দুর্গের সংলগ্ন স্থানে একটি শস্যাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই শস্যাগারটি হল লম্বায় 169 ফুট এবং চওড়ায় 135 ফুট (মতান্তরে, 150×200 ফুট)। বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শস্যাগারটি পোড়ামাটির উঁচু ভিতের ওপর তৈরি করা হয়। এতে কয়েকটি কক্ষ ছিল। পাশেই ছিল উচু বাঁধানো চাতাল। এখানে শ্রমিকরা শস্য ঝাড়াই-মাড়াই করত। শস্যাগারের পাশেই ছিল 2 কামরাযুক্ত শ্রমিকদের আবাসের কেন্দ্র। অধ্যাপক ব্যাসাম এই শস্যাগারটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হরপ্পার মতো মহেন-জো-দারোতেও ৪5×97 ফুটের একটি শস্যাগার পাওয়া গেছে। যদিও অনেকে এটিকে সভাগৃহ বলে মনে করেন।
• স্নানাগার:
মহেন-জো-দারোতে দুর্গের কাছেই একটি স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই স্নানাগারের বাইরের দিকের মাপ ছিল 180×108 ফুট। স্নান করবার জলাধারটির মাপ ছিল 39 × 23 ফুট এবং গভীরতা ৪ ফুট। জলাধারটিতে জল ঢোকাবার এবং বের করবার ব্যবস্থা ছিল। এর একপাশে বসবার জন্য মঞ্চ ছিল। জলাধারের অন্য তিন পাশে বারান্দা এবং তার পাশে ছোটো ছোটো ঘর ছিল। মর্টিমার তুইলার-এর মতে, এই স্নানাগারটি একটি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়।
• পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা:
হরপ্পা নগরগুলির বাসগৃহের জলনিকাশি ব্যবস্থা ছিল খুবই উন্নত। প্রতি বাড়ির জল বের হওয়ার জন্য পোড়ামাটির ইটের তৈরি নালি ছিল। এই নালিপথে জল নির্গত হয়ে রাস্তার পয়ঃপ্রণালীতে পড়ত। রাস্তার পাশে গর্ত করে নর্দমা তৈরি করা হত। এই নর্দমা পাথরের ঢাকনা দ্বারা চাপা দেওয়া থাকত। কোথাও ইটের তৈরি আবর্জনা ফেলার চৌকো চৌবাচ্চা ছিল। চৌবাচ্চা ও নালিগুলি নিয়মিত পরিষ্কারের কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে। সিন্ধু নগরগুলির মতো পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা প্রাচ্যদেশে আর ছিল না।
• নাগরিক জীবন:
হরপ্পা সভ্যতা ছিল নাগরিক সভ্যতা। নগরকে কেন্দ্র করেই এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এখানকার মানুষ এক পরিচ্ছন্ন ও উন্নত নাগরিক জীবনযাপন করত। নাগরিকদের সুযোগসুবিধার দিকে লক্ষ রেখে সুপরিকল্পিতভাবে নগর নির্মিত হয়। রাতে নগরের রাস্তায় আলো ও প্রহরীর ব্যবস্থা ছিল। রামশরণ শর্মা মনে করেন, এই নাগরিক সভ্যতায় শাসকশ্রেণি যুদ্ধ অপেক্ষা বাণিজ্যে বেশি আগ্রহী ছিল এবং সম্ভবত বণিক শ্রেণিই ছিল এই নাগরিক সভ্যতার পৃষ্ঠপোষক। এককথায়, একটি উন্নত নগরে যা যা থাকা দরকার প্রায় সবকিছুই উপস্থিত ছিল হরপ্পা ও মহেন-জো-দারোর মতো নগরগুলিতে।