হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে লেখো। অথবা, সিন্ধু সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?

হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য:

1921-22 সালে পাঞ্জাবে হরপ্পা ও সিন্দুপ্রদেশে মহেন-জো-দারো নগরীর আবিষ্কার ভারতে ইতিহাস চর্চার ধারাকে প্রভাবিত করেছে। তবে এই সভ্যতার স্বরূপ বা চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের প্রধান সমস্যা হল লিখিত উপাদানের অভাব। কারণ সিষ্ণু লিপি এখনও পাঠোদ্ধার হয়নি। তাই ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণ হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর ওপর নির্ভর করে এই সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র সম্পর্কে ধারণা করেছেন। সেগুলি হল-

• প্রায়-ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতা:

প্রায়-ঐতিহাসিক যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল লিখিত উপাদান থাকবে কিন্তু সেগুলি পাঠোদ্ধার করা যায়নি। অনুরূপভাবে হরপ্পা সভ্যতা হল প্রায়-ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতা। কারণ হরপ্পার সীলমোহরগুলিতে যে সিন্ধুলিপি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি এখনও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

• তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা:

হরপ্পা সভ্যতাকে তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা বলা যায়। কারণ এই সময় (3000-1500 খ্রি.পূ.) পাথরের ব্যবহার কমতে থাকে এবং তামার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। হরপ্পা সভ্যতাতে পাথরের হাতিয়ার বা অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি তাজ ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ার এবং সরঞ্জাম ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়।

• নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা:

মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন ও মিশর সভ্যতার মতো হরপ্পা সভ্যতাও ছিল নদীকেন্দ্রিক। নীলনদকে কেন্দ্র করে যেমন মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি সিন্ধুনদকে কেন্দ্র করে হরপ্পা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। মূলত সিন্ধু ও তার শাখা ও উপনদীগুলির তীরে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে হরপ্পা সভ্যতাকে ‘নদীমাতৃক সভ্যতা’ও বলা হয়।

• নগর সভ্যতা:

বর্তমানে হরপ্পা সভ্যতার প্রায় 1500টি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি শহর নামের অধিকারী। নগর কেন্দ্রগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল হরপ্পা ও মহেন-জো-দারো। এ ছাড়া চানহুদারো, কোটদিজি, রূপার, আলমগীরপুর, লোখাল, রংপুর, রোজদি, সুরকোটরা, কালিবঙ্গান, বানওয়ালি প্রভৃতি স্থানে উন্নত নগরজীবনের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব নগরের স্নানাগর, শস্যাগার, রাস্তাঘাট, পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, বাড়িঘর প্রভৃতি নিদর্শন হুবহু আধুনিক শহরের সমতুল্য। তাই হরপ্পা সভ্যতাকে ‘নগর সভ্যতা’ বলা হয়।

• রক্ষণশীল মানসিকতা:

ক্রমে হরগ্লাবাসীদের মনে রক্ষণশীলতা দানা বাঁধে, যার ছাপ পরে রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর তৈরিতে। রাস্তাগুলি ক্রমে ছোটো হয়ে যায়। নতুন কিছু গ্রহণ করার, যেমন-মেসোপটেমিয়ার উন্নত সেচপ্রযুক্তি গ্রহণ করার মানসিকতা তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। তারা গতানুগতিক চিরাচরিত পদ্ধতিতে জীবনযাপন করত।

• সর্বত্র একই রকম জীবনযাপন:

প্রায় 13 লক্ষ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হরয়া সভ্যতায় একইরকম জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। নগরগুলির পরিকল্পনা, গঠনরীতি, জীবনযাপনের রীতিনীতি সর্বত্র প্রায় একই রকম। তারা একই রকম ওজন ও মাপের পদ্ধতি ব্যবহার করত।

• শ্রেণিবৈষম্য:

সিখুসভ্যতার নগর বিন্যাসের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য লক্ষ করা যায়। দুর্গ, প্রাসাদ, স্নানাগার, ক্ষুদ্র ঘর, শস্যাগার, শ্রমিক শ্রেণি, পুরোহিত, ব্যবসায়ী, যোদ্ধা প্রমুখের উপস্থিতি এই সভ্যতার শ্রেণিবৈষম্যের পরিচয় বহন করে।

• গৌরশাসন:

সিন্ধু সভ্যতায় বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের প্রায় সর্বত্র একই ধরনের ধারাবাহিক চরিত্র লক্ষ করে ঐতিহাসিকগণ এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে, এখানে একটি কেন্দ্রীভূত পৌরশাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। যদিও ঠিক কি ধরনের শাসক শাসন করতেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা একমত নন। ব্যাবসাবাণিজ্যকেন্দ্রিক সভ্যতা। যে-কোনো শহর বা নগর গড়ে ওঠে

• ব্যাবসাবাণিজ্যকে কেন্দ্র করে:

হরপ্পা সভ্যতাতেও বিপুল পরিমাণে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবসাবাণিজ্যেরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বিদেশের সঙ্গে তথা মিশর, ব্যাবিলন, সুমেরুর সঙ্গেও বাণিজ্যিক যোগাযোগ ঘটে এবং হরপ্পা সভ্যতা একটি ব্যাবসাবাণিজ্য নির্ভর সভ্যতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

• মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতা

পোড়ামাটির তৈরি বহু সংখ্যক দেবীমূর্তির নিদর্শন এবং নগ্ন নারীমূর্তির আধিক্য দেখে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন হরপ্পা সভ্যতা মূলত মাতৃতান্ত্রিক ছিল এবং এখানে মাতৃদেবীর প্রাধান্য ছিল।

চালান পরিশেষে বলা যায়, প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে অনুমান করে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করেছেন। তবে সিন্দু লিপির পাঠোদ্ধার হলে এবং খনন- কার্যের আরও অগ্রগতি ঘটলে হরপ্পা সভ্যতার নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য জানা সম্ভব হবে।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading