অ্যারিস্টটল তার বিখ্যাত গ্রন্থ Poetics-এ ‘প্লট’ (Plot) বা কাহিনির কাঠামোকে নাট্যকাব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অ্যারিস্টটল মনে করতেন, একটি সার্থক নাট্যকাব্যের মূল আকর্ষণ তার প্লটের গঠনশৈলীতে নিহিত। প্লট হল সেই কাঠামো, যার মাধ্যমে কাহিনির ঘটনাগুলো সুনির্দিষ্ট ধারায় সংঘটিত হয় এবং একটি সমগ্র রূপে পরিণত হয়।
অ্যারিস্টটলের প্লটের ধারণা
অ্যারিস্টটল প্লটকে ‘মিথোস’ (Mythos) নামে অভিহিত করেছেন, যা আক্ষরিক অর্থে ‘কাহিনি’ বা ‘আখ্যান’। তবে তাঁর দৃষ্টিতে প্লট মানে শুধুমাত্র কোনো কাহিনির ধারাবাহিক বর্ণনা নয়, বরং এটি হলো ঘটনাবলির একটি সুশৃঙ্খল বিন্যাস। অ্যারিস্টটল মনে করেন, প্লটের মাধ্যমে ঘটনাগুলোর মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং এই সম্পর্কের মাধ্যমে কাহিনির একটি যৌক্তিক পরিণতি আসে। প্লটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর unity of action—অর্থাৎ, কাহিনির প্রতিটি অংশ এমনভাবে সাজানো থাকবে যাতে একটি অংশ বাদ দিলে পুরো কাহিনি অর্থহীন হয়ে যায়।
তিনি প্লটের দুটি প্রধান ধরণের কথা বলেছেন:
- Simple Plot: যেখানে কাহিনির মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিণতি বা মোড় নেই।
- Complex Plot: যেখানে peripeteia (পরিণতির বিপরীত পরিবর্তন) এবং anagnorisis (চরিত্রের আত্মোপলব্ধি) ঘটে। এই ধরনের প্লটকে অ্যারিস্টটল শ্রেষ্ঠ মনে করেছেন, কারণ এতে কাহিনির নাটকীয়তা এবং আবেগের গভীরতা বৃদ্ধি পায়।
প্লট ও চরিত্রের মধ্যে গুরুত্ব
অ্যারিস্টটল স্পষ্টভাবে বলেছেন যে প্লটের গুরুত্ব চরিত্রের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর মতে, “প্লট চরিত্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মানুষ তাদের চরিত্রের জন্য নয় বরং তাদের কাজের জন্য সুখী বা দুঃখী হয়।” অর্থাৎ, অ্যারিস্টটল মনে করতেন চরিত্র কাহিনির একটি অংশমাত্র, যেখানে প্লট হলো পুরো কাহিনির মূল কাঠামো। প্লটের মূল লক্ষ্য হলো কাহিনির মাধ্যমে একটি সামগ্রিক ভাবের সৃষ্টি করা, যা চরিত্রের মাধ্যমে প্রভাবিত হলেও পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়।
প্লট বনাম চরিত্র: অ্যারিস্টটলের যুক্তি
অ্যারিস্টটলের মতে, চরিত্রগুলো প্লটের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির বাহক মাত্র। চরিত্রের কাজ হলো প্লটকে কার্যকর করা এবং তার মাধ্যমে নাট্যকাব্যের উদ্দেশ্য পূরণ করা। চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি প্লটের মাধ্যমে ফুটে ওঠে, তবে প্লটের কোনো অংশ সরিয়ে ফেললে কাহিনির গুরুত্ব ও আবেদন হারিয়ে যাবে, যেখানে কোনো একটি চরিত্র বাদ পড়লেও কাহিনির মূল কাঠামো অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অ্যারিস্টটল প্লটকে ‘কাব্যের আত্মা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তাঁর মতে, শ্রেষ্ঠ প্লট হলো সেই প্লট যা “শুরু, মধ্য ও শেষ” নিয়ে গঠিত এবং এটি এমন একটি সমন্বিত কাহিনি যা নিজেই নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে প্লটের সার্থকতা নির্ভর করে কাহিনির প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত মোড় এবং সংবেদনশীল ঘটনার ওপর, যা পাঠক বা দর্শকের মনে সাড়া জাগায়।
সমালোচনা এবং মূল্যায়ন
অ্যারিস্টটলের প্লটকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্তের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদিও প্লট নাট্যকাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, আধুনিক সাহিত্যে চরিত্রের গভীরতা এবং তাদের মানসিক জটিলতা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে চরিত্রনির্ভর উপন্যাস ও নাটকে চরিত্রের বিকাশই কাহিনির প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বে, প্লট এবং চরিত্র উভয়কেই সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়, কারণ চরিত্রের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব বা বিকাশের মাধ্যমেই অনেক সময় কাহিনির সার্থকতা নির্ধারিত হয়।
উপসংহার
অ্যারিস্টটল যে প্লটকে কাব্যের প্রাণ হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা তাঁর সময়ের প্রেক্ষাপটে যথার্থ ছিল। তবে আধুনিক সাহিত্যে চরিত্রের জটিলতা এবং তাদের অন্তর্নিহিত মানসিকতার গুরুত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্লট এবং চরিত্রের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার, কারণ একটি সার্থক কাহিনির জন্য উভয় উপাদানই অপরিহার্য। কিন্তু অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের এখনও শিখিয়ে যায় যে, একটি সুশৃঙ্খল এবং সংহত প্লট কাহিনির প্রভাবকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা সাহিত্যের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।