আকবরের সময়ে স্থাপত্যের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

মুঘল সম্রাট আকবর স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে চরম অনুরাগের পরিচয় দেন। আকবরই ভারতীয় উচ্চমানের শিল্প-স্থাপত্যের ধারার সঙ্গে তুর্কি জাতির শিল্প-স্থাপত্যের উচ্চধারণার সংমিশ্রণে স্থাপত্যশিল্পে ‘ভারতীয় ধারার সূচনা করেন। আকবরের আমলে নির্মিত অট্টালিকা, প্রাসাদ, মসজিদ, সমাধিসৌধ ও দুর্গগুলিতে ভারতীয় ও পারসিক উভয় রীতির প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়। এইভাবে ভারতে ‘মুঘল স্থাপত্যশৈলী’-র জন্ম হয়।

বলা হয় , আকবরই হলেন মুঘল স্থাপত্যশৈলীর প্রতিষ্ঠাতা। আমলে নির্মিত প্রথম উল্লেখযোগ্য সৌধটি ছিল হুমায়ুনের সমাধি (নির্মাণ শুরু হয় ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে)। এই সমাধি নির্মাণে পারসিক স্থাপত্যের প্রভাব ছিল। পারসিক রীতির অনুকরণে গঠিত ‘কুতুবি স্থাপত্যরীতি’ হুমায়ুনের সমাধি নির্মাণে অনুসরণ করা হয়। পার্সি ব্রাউন বলেছেন, এটি ছিল পারস্যশৈলীর ভারতীয়করণ। এই রীতিটি শাহাজাহানের আমল পর্যন্ত বজায় ছিল। হুমায়ুনের সৌধটি ২২ ফুট উঁচু বেদীর উপর নির্মিত; মূল ভবনের চারকোনে চারটি মিনার এবং একটি ছোটো গম্বুজ; চূড়ার গম্বুজটি মার্বেল পাথরে নির্মিত। ড. সরসীকুমার সরস্বতীর মতে, এই সমাধি ভবনের মর্মর প্রস্তর-গম্বুজ ‘তৈমুরি স্থাপত্যরীতি’ থেকে বিচ্ছিন্নতা প্রমাণ করে। সৌধটির ভিতরের কক্ষগুলির একেবারে মাঝেরটিতে সম্রাটের সমাধি অবস্থিত। সৌধটি আয়তাকার এবং এর চারদিকে ছিল প্রশস্ত উদ্যান।

আকবর তিনটি বিশাল দূর্গ নির্মাণ করেন—আগ্রা, লাহোর ও এলাহাবাদে। আকবর স্বয়ং আগ্রা দুর্গে দীর্ঘকাল বসবাস করেন। মহম্মদ কাশিম খাঁ-র পরিকল্পনায় দীর্ঘ আট বছরে (১৫৬৫-১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ)।

আগ্রা দূর্গটি নির্মিত হয় যমুনা নদীর দক্ষিণ তীর বরাবর। এই দূর্গ নির্মাণে আকবর পারসিক স্থাপত্যরীতির সঙ্গে বাংলা ও গুজরাটী স্থাপত্যশৈলীও ব্যবহার করেন। আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আকবর দূর্গটির ভিতরে প্রায় পাঁচশ লাল বেলেপাথরের অট্টালিকা নির্মাণ করেন। এইভাবে পারসিক স্থাপত্যের ভারতীয়করণ ঘটে। পার্সি ব্রাউন আবার মন্তব্য করেছেন—আগ্রা দূর্গের নির্মাণে রাজা মানসিংহের কাছ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করা হয়। মানসিংহের প্রাসাদের সঙ্গে আগ্রার দুর্গ প্রাসাদের সাদৃশ্য বিস্ময়কর। এই রাজপুত রাজার স্থাপত্যশৈলী আকবর বহু অংশে অনুকরণ করেন।

আগ্রা দূর্গের মধ্যে ‘আকবরী মহল’ ও ‘জাহাঙ্গীর মহল’ নামে দু’টি প্রাসাদ নির্মিত হয়। এই দুই প্রাসাদের নির্মাণে ভারতীয় রীতিরই (গুজরাটী, বাংলা ও রাজস্থানী) প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রাসাদগুলির দেওয়ালে হাতি, সিংহ ও ময়ূরের ছবি সযত্নে আঁকা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ভারতীয় রীতির নিদর্শন। ‘আকবরী মহল ‘টি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও ‘জাহাঙ্গীর মহল’টি এখনও টিকে আছে। অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন—জাহাঙ্গীর মহলের কতগুলি বৈশিষ্ট্য বৃন্দাবনের গোবিন্দ দেবের মন্দিরের কথা এমনভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, হয়তো একই স্থপতি উভয় সৌধের পরিকল্পনা করেছিলেন—একথা ভাবা অসঙ্গত নয় ।

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আকবর ‘ফতেপুর সিক্রি’-তে একটি নতুন নগর পত্তন করেন এবং সেখানে বহু প্রাসাদ নির্মাণ করেন। দরবেশ সেলিম চিস্তির সমাধি ঘিরে একটি পর্বতের উপর এই নগরটি গড়ে উঠেছিল। এর পরিকল্পনা করেন মহম্মদ কাশীম খাঁ। ‘ফতেপুর’শব্দের অর্থ ‘বিজয় নগরী’। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে আকবরের গুজরাট জয়ের স্মারক হিসেবে নগরীটি নির্মিত হয়। ফতেপুর সিক্রিতে নির্মিত প্রাসাদগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—জামি মসজিদ, বুলন্দ দরওয়াজা, বীরবলের প্রাসাদ, অম্বর রাজকুমারীর আবাসগৃহ, পঞ্চমহল, সোনহেলা মকাব ইত্যাদি। ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে আকবর তাঁর দক্ষিণ ভারত অভিযানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ফতেপুর সিক্রির সামনে ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ নির্মাণ করেন। এর উচ্চতা ভূমি থেকে ১৭৬ ফুট। এটি ভারতের সবচেয়ে উঁচু দরওয়াজা। দরওয়াজার উপরে অনেকগুলি ছত্রী বিশাল আকাশের পটভূমিতে স্থাপতাটিতে বিস্ময়কর মাত্রা যুক্ত করে। ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ সম্পর্কে পার্সি ব্রাউন মন্তব্য করেছেন—’One of the most per fect architectural developments in the whole of India’

ফতেপুর সিক্রির জামি মসজিদের ভিতরে আকবরের ঘনিষ্ঠ সুফি সত্ত সেলিম চিস্তির সমাধি রয়েছে। আকবর এই সমাধিটি মার্বেল পাথর দ্বারা আবৃত করেন। ইসলাম খাঁ-র সমাধিও এখানে রয়েছে। এই জামি মসজিদটি তিনটি গম্বুজদ্বারা শোভিত। পার্সি ব্রাউন লিখেছেন—অত্যন্ত সুপরিকল্পনা নিয়ে ও দক্ষতার সঙ্গে ফতেপুর সিক্রির সবচেয়ে সুন্দর স্থাপত্য জামি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। ‘পঞ্চমহল’ নামক গৃহটি ছিল পাঁচতলা এবং পিলারের উপর স্থাপিত। ‘দেওয়ান-ই-খাস’-র বিশাল হলঘরের স্তম্ভগুলি এখানে এমনভাবে নির্মিত যে সম্রাটের আসন কোনোভাবেই আড়াল পড়ে না।

ফতেপুর সিক্রির শিল্প সুষমা সম্পর্কে বলা হয়েছে—it still forms a most remarkable impressive revilation of a mighty personality’। ভিনসেন্ট স্মিথ ফতেপুরকে ‘পাথরের তৈরি কল্পনা ও স্বপ্ন’ (‘a romance in stone’) বলে বর্ণনা করেছেন।

ফতেপুর সিক্রি ও আগ্রার মধ্যবর্তী অঞ্চলের সেকেন্দ্রা নামক স্থানে আকবরের সমাধিভবনটি অবস্থিত। আকবরের আমলে এর নির্মাণ কাজ শুরু হলেও জাহাঙ্গীরের আমলে এটি সমাপ্ত হয়। এই সৌধ নির্মাণে অনেকে বৌদ্ধবিহারের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। ফার্গুসন এর সঙ্গে আবার মহাবলীপুরমের রথের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। আকবর দিল্লীর পশ্চিম দিকে বিখ্যাত ‘হাতি দরওয়াজা’ নির্মাণ করেন। আকবরের আমলে নির্মিত হুমায়ুনের সমাধির প্রাদেশিক স্থাপত্য ছিল গোয়ালিয়রের মহম্মদ ঘাউসের সমাধি। এছাড়াও এসময় গোয়ালিয়রে তোমর বংশীয় রাজা মানসিংহের প্রাসাদ উল্লেখের দাবি রাখে।

মূল্যায়ন :

আকবরের অনুসৃত স্থাপত্যরীতিতে ভারতীয় স্থাপত্যরীতির মিশ্রণ ঘটলেও বৈদেশিক পারসিক রীতিরই আধিক্য দেখা যায়। আকবরের স্থাপত্যরীতি আবার রাজপুত স্থাপত্যরীতিকে প্রভাবিত করে। আকবরের আমলে নির্মিত অম্বর রাজপ্রাসাদ, বিকানির রাজপ্রাসাদ ও যোধপুর রাজপ্রাসাদে আকবরের অনুসৃত স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মুঘল স্থাপত্য ও রাজপুত স্থাপত্যের সমন্বয়ে এই পর্বে এক অভূতপূর্ব জাতীয় স্থাপত্যরীতির প্রবর্তন ঘটে। প্রসঙ্গত, বৃন্দাবনের হিন্দু মন্দির নির্মাণেও মুঘল স্থাপত্যরীতিকে গ্রহণ করা হয়েছিল।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading