গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর গৌড়ের স্বাধীনতা বিপন্ন হলে কনৌজের মৌখরী রাজারা গৌড় দখলের চেষ্টা করেন। আবার চালুক্য বংশীয় রাজাদের নিরন্তর আক্রমণ গৌড়ের অস্তিত্বকে দূর্বল করে তুলেছিল। গৌড়ের এই টলায়মান অবস্থায়, সপ্তম শতকের সূচনায় জনৈক শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীন স্বতন্ত্র নরপতিরূপে দেখা দেন এবং গৌড়রাষ্ট্র উত্তর ভারতের ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র বিশিষ্ট অধ্যায় রচনা করেছে। শশাঙ্কের রাজত্ব সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের মূলত নির্ভর করতে হয় বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ ও হিউয়েন সান্ডের বিবরণী ‘সি-ইউ-কি’-র ওপর।
শশাঙ্কের বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। রোহিতাশ্বের গিরিগাত্রে ‘শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক’ নামটি খোদিত আছে। এখানে মনে হয় গৌড়রাজ শশাঙ্কের কথাই বলা হয়েছে। এ ছাড়া ‘হর্ষচরিত’ প্রণেতা বাণভট্ট শশাঙ্ককে ‘গৌড়াধিপ’, এবং ‘গৌড়ভুজঙ্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন। হিউয়েন সাং কর্ণসুবর্ণের রাজা হিসেবে শশাঙ্কের পরিচয় দেন। গৌড়ে বা বরেন্দ্রদেশে শশাঙ্কের সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বলে তাঁকে ‘গৌড়াধিপ’ উপাধি দেওয়া হয় এবং তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ, রাঢ়দেশে অবস্থিত বলে স্থির করা হয়।
শশাঙ্কের প্রথম পরিচয় মহাসামন্তরূপে। ড. বি সি সেন মনে করেন, শশাঙ্ক মৌখরীদের অধীন সামন্ত নৃপতি ছিলেন। আবার মনে করা হয় মহাসেনগুপ্ত বা তৎপরবর্তী মালবাধিপতি দেবগুপ্ত তার অধিরাজ ছিলেন। রাজ্যবর্ধনের কাছে দেবগুপ্তের পরাজয়ের পর শশাঙ্কই যে দেবগুপ্তের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তা থেকে মনে হয় শশাঙ্ক মগধ মালবাধিপতি গুপ্ত রাজাদেরই মহাসামন্ত ছিলেন। সে যাই হোক না কেন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলতে চেয়েছেন-“শশাঙ্কই প্রথম বাঙালি রাজা যিনি আর্যাবর্তে সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।”
সুতরাং, দেখা যায় শশাঙ্ক সামান্য একজন সামন্ত থেকে নিজ বাহুবলে বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন এবং মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে তাঁর রাজধানী গড়ে তুলেছিলেন।
সিংহাসনে বসেই তিনি রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। গৌড়ের অধিপতি হিসেবে উত্তর ও পশ্চিম বাংলার ওপর হয়তো প্রথম থেকেই তার আধিপত্য ছিল। মেদিনীপুর লেখ থেকে জানা যায় তিনি দণ্ডভুক্তি বা মেদিনীপুর জেলার দাঁতন ও উৎকল জয় করেন। এই অঞ্চল দুটি সামন্তদের দ্বারা শাসিত হত। ওড়িশার কোাদ অঞ্চলে রাজত্বকারী শৈলোদ্ভব রাজবংশও তার বশ্যতা স্বীকার করে। তাম্রফলকে একজন গৌড়রাজের উল্লেখ আছে, যিনি কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণকে পরাস্ত করেছিলেন। পন্ডিতগণ মনে করেন, এই গৌড়রাজ ছিলেন শশাঙ্ক।
শশাঙ্কের অন্যতম কৃতিত্ব ছিল এই যে তিনি পশ্চিমে কনৌজ রাজ্যের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কনৌজের মৌখরীরা ছিলেন গৌড়ের শত্রু। শশাঙ্ক মালবরাজ দেবগুপ্তের সঙ্গে মৈত্রী গঠন করে থানেশ্বরের রাজা গ্রহবর্মণকে হত্যা ও তাঁর কন্যা রাজ্যশ্রীকে লুন্ঠন করে নিয়ে যান। রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার জন্য তাঁর ভ্রাতা রাজ্যবর্ধন মালব আক্রমণ করে মালবরাজ দেবগুপ্তকে হত্যা করেন। কিন্তু এক আকস্মিক আক্রমণে শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেন এবং এই অবস্থায় থানেশ্বরের নতুন রাজা হর্ষবর্ধন প্রতিশোধ গ্রহণে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তবে হর্ষবর্ধন তাঁর ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করলেও শশাঙ্কের সঙ্গো আদৌ তাঁর যুদ্ধ হয়েছিল কিনা, তা জানা যায় না, কারণ বাণভট্ট ও হিউয়েন সাং এ বিষয়ে বিশেষ কিছু উল্লেখ করেননি। তবে জীবিতকালে হর্ষবর্ধন যে শশাঙ্ককে পরাজিত করতে পারেননি তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, মৃত্যুর সময় পর্যন্ত মগধ শশাঙ্কের অধীনে ছিল। ধর্মীয় দিক থেকে শশাঙ্ক ছিলেন শৈব এবং বৌদ্ধদের প্রতি তাঁর চরম বিদ্বেষ ছিল। হিউয়েন সাং-এর বিবরণ থেকে জানা যায় শশাঙ্ক বৌদ্ধদের ওপর নানা রকম অত্যাচার চালিয়েছিলেন। যেমন- কুশীনগর বিহার থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়ন, পাটলিপুত্রে বুদ্ধের চরণচিহ্ন অঙ্কিত প্রস্তরখণ্ড গঙ্গায় নিক্ষেপ, বোধিবৃক্ষ ছেদ, বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের অপচেষ্টা করে শিবমন্দির নির্মাণ ইত্যাদি। শশাঙ্কের এই বৌদ্ধ বিদ্বেষের কারণ হিসেবে কোনো-কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে বৌদ্ধরা হর্ষবর্ধনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে শশাঙ্ক বৌদ্ধদের প্রতি বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। তবে শশাঙ্কের এই বৌদ্ধ নির্যাতনের কাহিনি কিছুটা অতিরঞ্জিত বলেই মনে হয়, কারণ হিউয়েন সাং-এর বিবরণী থেকে জানা যায় তিনি তাম্রলিপ্ত ও কর্ণসুবর্ণে বৌদ্ধ স্তূপ দেখেছিলেন এবং গৌড়ের বৌদ্ধ মঠে বহু বৌদ্ধ নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতেন।
পরিশেষে বলা যায়, শশাঙ্ক কেবল শক্তিশালী বাংলাই গঠন করেননি, উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাকে মর্যাদার আসনেও অধিষ্ঠিত করেছিলেন। শশাঙ্কের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে গাল রাজারা বাংলাকে কেন্দ্র করে বিশাল সাম্রাজ্য গঠনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। শাসক হিসেবে তিনি স্বতন্ত্র রীতির প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই রীতিকেই ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় ‘গৌড়তন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছেন। বস্তুত শশাঙ্কের সময়েই বাংলার প্রশাসনে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য স্বীকৃতিলাভ করে।