আশাপূর্ণা দেবীর ‘ইজ্জত’ গল্পে বর্ণিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বরূপ উন্মোচন করো।

আশাপূর্ণা দেবীর ‘ইজ্জত’ গল্পে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বরূপ উন্মোচন

আশাপূর্ণা দেবী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার, যিনি সাধারণ মানুষের জীবনের জটিলতা ও দুঃখ-দুর্দশার অতি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। তাঁর গল্প ‘ইজ্জত’ ১৯৪৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং এটি একদিকে যেমন নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শোষণের প্রেক্ষাপটে লেখা, তেমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কৃত্রিম ও নিষ্ঠুর মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটি চমৎকার প্রতিবাদ। গল্পটি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও নারীর উপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরে, যা সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ।

১. পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরিচয়

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে পুরুষরা সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলিতে অধিকৃত অধিকার ও ক্ষমতার অধিকারী থাকে, এবং নারীরা সাধারণত পুরুষের দাস বা সেবা প্রদানকারী হিসেবে গণ্য হয়। এই সমাজে নারীর মূল্য তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, তার “ইজ্জত” বা সম্মানকে সমাজের চোখে উজ্জ্বল রাখা এবং পুরুষের ইচ্ছার উপর তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ সীমাবদ্ধ করা।

২. গল্পের মূল কাহিনি এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র

‘ইজ্জত’ গল্পটির মূল চরিত্র মহেন্দ্রের মা—এক বৃদ্ধা মহিলা যিনি সমাজের যে “ইজ্জত” বা সম্মানকে পুঁজি করে পুরুষের শোষণ ও নারীর পাথেয়র সম্পর্ক স্থাপন করেন, তা ক্রমশ তার পরিবারকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এই মহিলা তাঁর পরিবারের কাছে “ইজ্জত” বা সম্মান রক্ষার জন্য অনেক কিছু করতে প্রস্তুত, এমনকি তাঁর ছেলের সুখ বা মানসিক শান্তিও নয়।

গল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল মহেন্দ্র—যিনি একটি মেয়ে প্রস্তাবিত হয়েছিল, তবে সে তার সামাজিক মর্যাদা ও ইজ্জত নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করে। গল্পের মধ্য দিয়ে একজন মানুষকে তাঁর জীবনের দুঃখের বিষয়ে বাধ্য করানোর মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিকতার স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে।

৩. ইজ্জতের ধারণা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ

গল্পের মাধ্যমে আশাপূর্ণা দেবী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে গড়ে ওঠা এক নিষ্ঠুর চিত্র তুলে ধরেন, যেখানে “ইজ্জত” বা সম্মান শুধুমাত্র পুরুষদের ওপর নির্ভর করে এবং নারীর মান, মর্যাদা ও জীবনকে পুরুষদের ইচ্ছের সঙ্গে মাপা হয়। “ইজ্জত” সমাজে একধরনের সিলেবাস বা নিয়ম হয়ে দাঁড়ায় যা নারীর জীবনকে একাধারে শাসন ও শোষণ করতে থাকে। মহেন্দ্রের মা গল্পে তার ছেলের স্ত্রীর মনকে শেষ করে “ইজ্জত” রক্ষা করার চেষ্টা করেন, অথচ এই “ইজ্জত” তার নিজের পরিবারের জন্য একটি এক্সপ্লোয়েটিভ তন্ত্রে পরিণত হয়।

মহেন্দ্রর মা একে একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি হিসাবে দেখে, যার মাধ্যমে সে নিশ্চিত করতে চায় যে তার পরিবারের সম্মান বজায় থাকবে। কিন্তু সেই একই “ইজ্জত” এর অন্ধ অনুশাসন তার সংসার, সুখ ও মানবিকতা সবকিছুই শেষ করে দেয়।

৪. পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকার নারীরা

গল্পটির পরিপ্রেক্ষিতে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে নারীর অবস্থান একটি দ্বৈত সংগ্রাম হয়ে ওঠে। মহেন্দ্রর স্ত্রীর দৃষ্টিতে “ইজ্জত” শুধুমাত্র একজন মহিলার শারীরিক বা মানসিক আত্মনির্ভরশীলতার প্রতিবন্ধক নয়, বরং এটি একটি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মহেন্দ্রর স্ত্রীর মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, তার আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং পরিবারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা—সবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক নিদর্শন, যা নারীর মূল্যবোধ ও অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে।

৫. সমাজের দ্বৈত মানদণ্ড এবং পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা

গল্পে মহেন্দ্রর মা এবং তাঁর প্রতি পুরুষদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কৌশল প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে, তাকে যতটা সম্ভব ক্ষুদ্র এবং স্তব্ধ রাখা হয় যাতে সে কখনো তার ইচ্ছায় অগ্রসর না হয়। এটি পুরুষদের কাছে তার মর্যাদা ও সম্মান অর্জনের একটি উপায় হয়ে ওঠে।

মহেন্দ্রর স্ত্রীর মানসিক অবস্থা এবং তার পরিবারের অশান্তি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দ্বৈত মানদণ্ডের এক করুণ প্রতিফলন। একই সমাজে, একজন পুরুষ তার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য নারীর মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করায়, কিন্তু নারী তার জীবনের পুরো সময়টাই সীমাবদ্ধ থাকে পরিবার, সম্পর্ক এবং সমাজের মূল্যবোধের ভিত্তিতে।

৬. ‘ইজ্জত’ গল্পের চিত্রায়ন এবং প্রতিবাদ

আশাপূর্ণা দেবী ‘ইজ্জত’ গল্পের মাধ্যমে শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিত্রায়ন করেন না, বরং সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেন। গল্পটি সমাজে নারীর স্বাধীনতার গুরুত্ব এবং তার সম্মানকে এক অজানা কাঠামোয় ধারণ করার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বার্তা প্রদান করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে নারীর অদৃশ্য শৃঙ্খল, তার আস্থা ও আত্মসম্মানকে তুচ্ছ করে দেওয়া, এবং তার প্রাপ্য স্বাধীনতা ও অধিকারকে সংকুচিত করা, এই গল্পের মূল সমালোচনা।

উপসংহার

‘ইজ্জত’ গল্পটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতা ও নারীর অবস্থানকে গভীরভাবে চিত্রিত করে। গল্পটি শুধুমাত্র একটি সামাজিক সমালোচনা নয়, বরং নারীর আত্মবিশ্বাস এবং সম্মান রক্ষার সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় সাক্ষী। মহেন্দ্রর মায়ের ইজ্জত রক্ষা করার উদাহরণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্ধ সংস্কৃতি এবং নারীর বিরুদ্ধে শোষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে উন্মোচন করে। আশাপূর্ণা দেবী এই গল্পের মাধ্যমে নারীর সমান অধিকার এবং মর্যাদার পক্ষে শক্তিশালী একটি বার্তা প্রদান করেছেন।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading