ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার পর্যালোচনা করুন। Examine the theory of Historical Materialism.

ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার পর্যালোচনা

ভূমিকা


ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা বা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism) কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের মাধ্যমে বিকশিত একটি তত্ত্ব, যা সমাজের বিকাশ এবং পরিবর্তনের মূল ভিত্তি হিসেবে অর্থনৈতিক কাঠামোকে বিবেচনা করে। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এটি দাবি করে যে, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের উন্নয়নের ভিত্তি। অর্থাৎ, ইতিহাসের মূল চালিকা শক্তি হলো উপকরণের উৎপাদন, উৎপাদনের সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক শ্রেণি সংগ্রাম। এই তত্ত্বটি রাজনৈতিক অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এবং ইতিহাসবিদ্যার ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার মূল ধারণা


ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার মূল ধারণা হলো, সমাজের পরিবর্তন এবং বিকাশের মূল উৎস হলো অর্থনৈতিক কাঠামো এবং শ্রেণি সম্পর্ক। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মতে, সমাজের আর্থ-সামাজিক কাঠামো (বেস) এবং আইনি, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক কাঠামো (অবকাঠামো) এর মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। আর্থ-সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত হলে অবকাঠামোতেও পরিবর্তন আসে।

এই তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে এক একটি উৎপাদন ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকে, যা এক একটি শ্রেণিকে প্রধান ক্ষমতাসীন শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। শ্রেণিসংগ্রাম এই উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সাথে সমাজের বিকাশকে নির্ধারণ করে। এই ধাপগুলোকে যথাক্রমে প্রাক-ধর্মীয় সমাজ, দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার উপাদান

১. উৎপাদন সম্পর্ক:


ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো উৎপাদন সম্পর্ক। এটি বোঝায় যে, সমাজে কে উৎপাদন উপকরণের মালিক এবং কে এই উপকরণ ব্যবহার করে, তা নির্ধারণ করে। মার্কসবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী, উৎপাদন সম্পর্কই শ্রেণি বিভাজনের মূল ভিত্তি। মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে যে শ্রেণি সম্পর্ক বিদ্যমান, সেটাই সমাজের পরিবর্তন এবং বিকাশের মূল কারণ।

২. শ্রেণি সংগ্রাম:


শ্রেণি সংগ্রাম ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার কেন্দ্রীয় উপাদান। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সংঘাত এবং বিরোধ বিদ্যমান থাকে, যা ইতিহাসের বিকাশের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। দাসপ্রথা থেকে শুরু করে সামন্তবাদ এবং পুঁজিবাদ পর্যন্ত প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় শোষক এবং শোষিত শ্রেণির মধ্যে সংগ্রাম দেখা যায়। এই সংগ্রামের ফলে পুরানো সমাজব্যবস্থা ধ্বংস হয় এবং নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

৩. আর্থ-সামাজিক কাঠামো:


মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ইতিহাসের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি বোঝায় যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কই তার সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোকে গঠন করে। আর্থ-সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত হলে, সমাজের অন্যান্য কাঠামোতেও পরিবর্তন আসে।

৪. উৎপাদন শক্তি:


উৎপাদন শক্তি বলতে সেই সমস্ত উপকরণ এবং প্রযুক্তিকে বোঝায়, যা একটি সমাজের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে পরিচালিত করে। উৎপাদন শক্তির বিকাশের সাথে সাথে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং শ্রেণি সম্পর্কেও পরিবর্তন আসে। উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব সমাজের পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে কাজ করে।

৫. ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং আইনি কাঠামো:


মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সমাজের ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং আইনি কাঠামো মূলত অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিফলন। এগুলো সমাজের শাসক শ্রেণির দ্বারা নির্মিত এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। যেমন, ধর্ম প্রায়ই শোষিত শ্রেণিকে শোষণ মেনে নিতে উৎসাহিত করে এবং আইনি কাঠামো শাসক শ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করে।

ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সমালোচনা

১. অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ:


ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার একটি প্রধান সমালোচনা হলো এর অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ। সমালোচকরা মনে করেন যে, মার্কসবাদ সমাজের অন্যান্য উপাদান যেমন সংস্কৃতি, ধর্ম, এবং রাজনীতিকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কাঠামোকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছে। বাস্তবে, সমাজের এই উপাদানগুলোও পরিবর্তন এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. শ্রেণি সংগ্রামের সাধারণীকরণ:


মার্কসবাদ শ্রেণি সংগ্রামকে ইতিহাসের প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে দেখেছে, কিন্তু সব সমাজে এই তত্ত্বটি প্রযোজ্য নয়। অনেক সময়ে সমাজে শ্রেণি বিভাজনের পরিবর্তে জাতিগত, ধর্মীয়, এবং জাতীয় বিভাজন বেশি প্রভাবশালী হতে পারে। মার্কসবাদীরা এই বিষয়গুলো প্রায়ই উপেক্ষা করেন।

৩. সামাজিক পরিবর্তনের গতিশীলতা:


ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সামাজিক পরিবর্তনকে একটি নিয়মিত এবং পূর্বানুমানযোগ্য প্রক্রিয়া হিসেবে দেখে। তবে বাস্তবে, সামাজিক পরিবর্তন অনেক সময় অনিয়মিত এবং আকস্মিকভাবে ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, বিপ্লব বা সামাজিক আন্দোলন প্রায়ই হঠাৎ করে ঘটে, যা পূর্বানুমান করা যায় না।

৪. মানবিক ইচ্ছাশক্তি:


মার্কসবাদে বলা হয়েছে যে, ইতিহাসের পরিবর্তন মূলত অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে, কিন্তু মানবিক ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ভূমিকা অনেক সময় উপেক্ষা করা হয়েছে। অনেক সময় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের ইচ্ছা এবং নেতৃত্ব সমাজের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উপসংহার


ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সমাজবিজ্ঞান এবং ইতিহাসবিদ্যার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যা সমাজের বিকাশ এবং পরিবর্তনকে অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে সংযুক্ত করে বিশ্লেষণ করে। যদিও এতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং এটি সব সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তবে এটি একটি মূল্যবান দৃষ্টিভঙ্গি, যা আমাদেরকে সমাজের আর্থ-সামাজিক ভিত্তি এবং শ্রেণি সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি গভীর ধারণা প্রদান করে। এই তত্ত্বের সমালোচনা এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, এটি এখনও সমাজ এবং ইতিহাসের বিকাশের একটি প্রভাবশালী পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading