উত্তরবঙ্গে ইংরেজদের বসতির কথা আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, ভারতবর্ষে ইংরেজরা প্রথমে প্রবেশ করেছিল ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রয়োজনে এবং উত্তরবঙ্গেও তার বিকল্প হয়নি। উত্তরবঙ্গে ব্যাবসা ও কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা খতিয়ে ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী। মালদা জেলায় রেশমবস্তু উৎপাদনের কারখানা ও অন্যান্য ব্যাবসা স্থাপনের বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎ খতিয়ে দেখার জন্যই তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। তাঁরই সুপারিশক্রমে 1680 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে পুরোনো মালদা শহরের এক ভাড়াবাড়িতে উত্তরবঙ্গের প্রথম ইংরেজ কারখানা স্থাপিত হয়। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে ইংরেজরা স্থানীয় জমিদার রাজা রায়চৌধুরীর নিকট থেকে পুরোনো মালদা শহরের দুই মাইল দক্ষিণ-পূর্বে মোকদ্দমপুর মৌজায় 15 বিঘা জমি মাত্র 300 টাকায় কিনে নেন এবং নতুন কারখানা ও বসতি স্থাপন করেন। এইভাবেই শুরু হয় উত্তরবঙ্গোর মাটিতে ইংরেজের প্রথম প্রতিষ্ঠা।
মূলত ব্যাবসাবাণিজ্যের মূল ‘উদ্দেশ্য’ নিয়েই ইংরেজরা এদেশে পাড়ি দিয়েছিল। ব্যাবসাবাণিজ্যের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান ও অযৌক্তিক দাবি নিয়েই ইংরেজদের সঙ্গে মুসলিম রাজশক্তির প্রথম সংঘাত বাধে এবং তারই ফলে ক্রমান্বয়ে ভারতের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব ধীরে ধীরে ব্যবসায়ী ইংরেজের হাতে চলে যায়। আরেকটু গোড়া থেকে দেখতে গেলে দেখা যায়, 1498 খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে কালিকট বন্দরে এসে নামেন। পোর্তুগিজ এই নাবিকের জলপথে ভারতে আগমন ইউরোপের কাছে ভারতের দ্বার মুক্ত করে দিয়েছিল। অতঃপর পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ সকলেই বাণিজ্যের স্বার্থে ভারতে প্রবেশ করে। 1600 খ্রিস্টাব্দের 31 ডিসেম্বর মহারানি এলিজাবেথের নিকট থেকে পূর্বদেশীয় জলপথে একক বাণিজ্যের অধিকার পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুমাত্রা, জাভা ও ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। 1609 খ্রিস্টাব্দে ক্যাপটেন হকিন্স সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে সুরাটে কারখানা স্থাপনের অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হলেও 1613 খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীর ইংরেজদের প্রয়োজনীয় ফরমান প্রদান করেন। সম্ভবত নৌ-যুদ্ধে ইংরেজদের বিশেষ সুবিধা করা যাবে না জেনেই তিনি অগত্যা এই ‘ফরমান’ প্রদান করেন।
অনুরূপভাবে সম্রাট শাহজাহানের নিকট থেকেও ইংরেজরা একটি ফরমান জারি করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় আবগারি শুল্কমুক্ত অবাধ বাণিজ্যের অধিকার আদায় করে বার্ষিক মাত্র 3000 টাকা করদানের প্রতিশ্রুতিতে। নবাব শায়েস্তা খাঁ এ-ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করলে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ বাধে এবং 1680 খ্রিস্টাব্দে হুগলিস্থিত নৌ-ঘাঁটি থেকে তারা স্থানীয় ফৌজদারকে আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করে। দশ বছর বিরোধ ও সংঘাতের শেষে 1690 খ্রিস্টাব্দে নতুন সুবাদার ইব্রাহিম খাঁর সঙ্গে ইংরেজগণ আপাতত বিরোধ মিটিয়ে নেয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক লাভে বেপরোয়া ইংরেজ অনিবার্যভাবেই বাংলার নবাবদের সঙ্গে সামরিক সংঘাত এড়াতে পারেনি এবং যার অনিবার্য পরিণতিতে 1757 খ্রিস্টাব্দের 23 জুন পলাশির মাঠে নবাব সৈন্য পরাজিত হয় এবং ইংরেজগণ ভারতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে শাসকীয় ক্ষমতায় অবতীর্ণ হয়। পূর্ব ভারতে তাদের এই জয় হুগলি, কলকাতা ও মালদার কারখানার উৎপাদন, বিক্রয় এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য ব্যাবসাবাণিজ্য শুধু ফুলে-ফেঁপেই উঠল না, রাজশক্তির সহায়তায় একচেটিয়া কারবারের পথে, অযৌক্তিক সুবিধার মোড়কে, ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণের দ্বার সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গেল।
1757 খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাবকে পরাজিত করলেও ইংরেজরা বাংলার শাসনক্ষমতা প্রত্যক্ষভাবে হাতে নিল না। কারণ, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল অবাধ ব্যবসায় অর্থ রোজগার: শাসনের দায়িত্ব, খরচা ও ঝুটঝামেলা পোহানো নয়। কিন্তু ৭ বছর পর এই আর্থিক লোভেই অবশেষে তারা শুধুমাত্র ‘দেওয়ানি’ কার্যটি প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইল, কারণ সেখানে রয়েছে রাজস্ব। ব্যাপারটি খুবই সরল। বছরে মাত্র 26 লক্ষ টাকার প্রতিশ্রুতিতে দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় যথেচ্ছ রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার ব্রিটিশরা আদায় করে নেয়। অথচ নবাবের ওপর থাকে সারা বাংলার রাজ্যশাসনভার, তার জন্য বার্ষিক খরচা ধার্য হল মাত্র 53 লক্ষ টাকা। ফলে ইংরেজের হল বিপুল রাজস্বলাড, পূর্ব ভারতের জনগণের জীবনে নেমে এল অরাজকতার অন্ধকার। কারণ, অর্থহীন ক্ষমতাহীন পুতুল-সরকারের তথাকথিত নবাবগণ রাজ্যশাসনের অনুপযোগী হয়ে পড়লেন।
যাই হোক, 1765 খ্রিস্টাব্দে ‘দেওয়ানি’ লাভের সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলার তথা, সমস্ত ভূখণ্ড (উত্তরবলা, কোচবিহার আর বৈকুণ্ঠপুর বাদে) ইংরেজদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু এই বিরাট ভূখণ্ডকে তারা যথাযথ শাসনের স্বার্থে সুবিন্যস্ত করতে উদ্যোগী হয় না। রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর এই তিনটি মাত্র জেলার মধ্যে সম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গের বিশাল ভূখণ্ডকে শুধু নয়, সেইসঙ্গে ভাগলপুর বিভাগের কিছু অংশ, দক্ষিণ অসমের কিছু অংশ এবং গঙ্গার দক্ষিণেরও কিছু অংশকে শাসনের চেষ্টা করতে থাকে। এই রকম অবাস্তব চিন্তা ইংরেজদের মধ্যে ছিল, কারণ তারা কম খরচ করে শুধুমাত্র রাজস্ব আদায়ের দিকে চিন্তা করেছিল। তাই রাজস্ব আদায়ের জন্যও নিজস্ব প্রশাসনযন্ত্র তৈরি করার মধ্যে না গিয়ে সেই পুরোনো মধ্যস্বত্বভোগীদের বন্দোবস্তের নিয়মকেই তারা আঁকড়ে ধরে। কিন্তু যেটা হল তা হল আরও মারাত্মক অর্থাৎ, স্থায়ী মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে খাজনা আদায় না করে, ইজারাদারি ব্যবস্থার পত্তন। শিথিল ও ব্যয়বহুল নবাবি আমলাতন্ত্রের মধ্যে না গিয়ে বা জমিদারি জায়গিরদারি প্রথার স্বল্পস্থায়ী ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করে অতিরিক্ত লাভের আশায় ইজারাদারি প্রথার প্রবর্তন কৃষকদের কাছে মারাত্মক সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। কারণ অস্থায়ী ইজারাদার অতিরিক্ত নীলামের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে-কোনো পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহে আগ্রহী হয়েছিল। খাজনা ছাড়াও অতিরিক্ত অন্যান্য দাবি মেটাতে গিয়ে কৃষকদের আর্থিক বোঝা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে রাজ্যশাসনে ইংরেজদের অনীহা ও নবাবের অক্ষমতায় সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভেঙে পড়ে। পুরোনো শাসনপদ্ধতি ভেঙে পড়ে, অথচ নতুন শাসনপদ্ধতি গড়ে ওঠার ফলে উত্তরবঙ্গের সর্বত্র তখন চোর-ডাকাতের উপদ্রব, ফকির আর সন্ন্যাসীর লুঠতরাজ, ধন আর প্রাণের নিরাপত্তাহীনতা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।