বাংলা তথা ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের সবচেয়ে বড়ো সাফল্যের মধ্যে চা শিল্প ছিল বিনিয়োগের বড়ো ক্ষেত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। পূর্ব ভারতে অসম হল চা উৎপাদনে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা কেন্দ্র। অসমের পরেই বাংলা বিশেষত উত্তরবঙ্গ যেটি চা উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চল। প্রযুক্তিগতভাবে বাংলার সমগ্র চা উৎপাদনকারী অঞ্চলকে তিনটি বলয়ে ভাগ করা হয়েছে-তরাই, ডুয়ার্স এবং দার্জিলিং পাহাড়। এসব অঞ্চলগুলি দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার এলাকা ও উত্তর দিনাজপুরের একটি অংশ জুড়ে রয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়, দার্জিলিং জেলার দার্জিলিং মহকুমা, কার্শিয়াং উপবিভাগ ও কালিম্পং মহকুমাকে আচ্ছাদিত করে। ডুয়ার্স সম্পূর্ণভাবে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার জেলার একটি বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে উত্তরবঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা বাগানটি খোলা হয়। 1850 সালে দার্জিলিং-এর টুকভারে এবং 1852 সালে স্টেইনখাল ও আলুবারিতেও চা বাগান খোলা হয়। এরপর 1862 সালে তরাই অঞ্চলে ইউরোপীয় চা বাগান স্থাপিত হয় চামটায়, আর ডুয়ার্স অঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান “স্থাপিত হয় 1894 সালে গাজলডোবায়। বেশিরভাগ চা বাগানই ইউরোপীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং তারা তা বজায় রাখার জন্য ও তাদের ব্যাবসায় বাংলার অন্যন্য অঞ্চল থেকে অনুপ্রবেশকারীদের রোধ করার জন্য নানান ধরনের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল, যা তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল।
1880 এর দশক থেকে চা ইউরোপীয়দের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা এবং সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয় হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে চিনদেশের চা বিশ্ব অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার কিন্তু 1880 সালের পর থেকে ভারতীয় চা অর্থাৎ, উত্তরবঙ্গের চা ইউরোপীয় ভোক্তাদের প্রধান পণ্যে পরিণত হয়। এর ফলস্বরূপ চা চাষকে নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানি গড়ে ওঠে, যেগুলি পেশায় মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি হলেও বিশ্ববাজারে চা-এর বিপুল চাহিদার কথা মাথায় রেখে তারা চা শিল্পে বিনিয়োগ করতে থাকে। চা উৎপাদন ও রপ্তানিতে ইউরোপীয়দের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যবস্থাপনা সংস্থার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। ইউরোপীয় ম্যানেজিং এজেন্সিগুলি চা-এর স্টার্লিং ও রুপি উভয় কোম্পানিই পরিচালনা করে ঔপনিবেশিক ভারতে হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের চা-এর উৎপাদন অব্যাহত রাখে। উক্ত এজেন্সিগুলির মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ ও কলকাতার ব্যক্তিগত চা ব্যাবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে তারা ওই অঞ্চলের চা ইউরোপীয় বাজারে সরাসরি বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে। যদিও 1880-এর দশক থেকে গুটিকয়েক ভারতীয় ব্যবসায়ী উত্তরবঙ্গের চা কোম্পানিগুলির দায়িত্ব নেয়, তবে উত্তরবঙ্গে চা ব্যবসায় ইউরোপয়ীদের সমকক্ষ তারা কখনোই হতে পারেনি।
উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় দায়িত্ব সর্বোতভাবে ইউরোপীয় চা কোম্পানিগুলির হাতে ছিল, যেমন-Andrew Yule and Company, Shaw, Wallace and Company, Williamson Magor and Company, Duncan Bothers, Octavious Steel and Company এবং আরও অন্যান্য, যেগুলি দার্জিলিং প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, ডুয়ার্স প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং তরাই প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশনায় পরিচালিত হয় এবং এই অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের অন্যতম প্রধান ফলশ্রুতি হিসেবে দেখা দেয়। জলপাইগুড়ি শহরের উদ্ভব ও ভারতীয় উদ্যোক্তাদের দ্বারা এর বিকাশ ঘটে। দার্জিলিং অঞ্চলে ইউরোপীয়দের চ্যালেঞ্ঝস্বরূপ ভারতীয়রা জলপাইগুড়িতে ভিত্তি করে সেখানে চা বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেগুলি পরিচালনার জন্য ‘ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’, ‘তরাই ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এর মতো সংস্থাগুলি প্রতিষ্ঠিত করে একদিকে যেমন নিজেদের তথা ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল এবং অন্যদিকে, তারা ব্যবসায় ইউরোপীয়দের সমকক্ষ হওয়ার তাগিদ দেখিয়েছিল। এর মূলে ছিল ভারতীয়দের অর্থনৈতিক জাতীয়তার ধারণা। বাঙ্গালি তথা ভারতীয় উদ্যোক্তরা 1879 থেকে 1900 সালের মধ্যে জলপাইগুড়ি শহরে ৭টি যুক্ত কোম্পানি স্থাপন করেছিল, যথা-নিদাম, গুরজংঝোরা, আঞ্জুমান, চামুর্চি, কাঠালগুড়ি ও রামঝোড়া, রহিমাবাদ, চুনিয়াঝোড়া ও নক্সালবাড়ি চা কোম্পানি।
উত্তরবঙ্গে চা উৎপাদন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই এই অঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতেও নগরায়ণের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এবং এক্ষেত্রে The North Bengal State Railway (NBSR) এবং The Bengal Dooars Railway (BDR) বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। এই অঞ্চলে রেললাইন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গো মাড়োয়ারি, বিহারি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের লোকজন এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে। এ ছাড়া ইউরোপীয়রা বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আদিবাসীদের এই অঞ্চলে নিয়ে আসেন চা বাগানের পরিচর্যা ও পাতা তোলার কাজে নিয়োগ করার জন্য, কারণ এই অঞ্চলের আদিবাসীরা তা করতে চায়নি। অন্যদিকে, কিছু বাঙালি ও মাড়োয়ারিরা চা- এর ব্যাবসাকে সমগ্র বাংলা তথা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়ার উৎসাহ দেখিয়েছিল। এইভাবে উত্তরবঙ্গে আসা অভিবাসীরা চা শিল্পের বিকাশে সহায়তা করেছিল। 1947 সালে উত্তরবঙ্গো চা শিল্পে এক বিভাজন লক্ষ করা যায়। 1948 সালে ভারতের স্বাধীনতা ও বিভাজনের ফলে বহু ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বেশিরভাগই ভারত থেকে তাদের ব্যাবসা গুটিয়ে চলে যায়। এই শূন্যস্থান পূরণে ভারতীয় পুঁজিপাতিরা মূলত মাড়োয়ারিরা এই সুযোগটি কাজে লাগানোর এগিয়ে আসে এবং এই সময় ইউরোপীয় চা কোম্পানিগুলির মালিকানা ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তরিত হয়। এর ফলস্বরূপ ইউরোপীয়দের পরিচালিত চা সমিতিগুলির ভারতীয়করণ ঘটে। যেমন- Duars Planters Association থেকে হয় Duars Branch Indian Tea Association এবং Terai Planters Association হয় Terai Branch Indian Tea Association i .