উত্তরবঙ্গে চা বাগানের প্রবর্তন ও সেইসঙ্গে উত্তরবঙ্গের বাইরে থেকে আসা শ্রমিকগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি, এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনযাপনের এক অন্য দিক খুলে দিয়েছিল। এই অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যথা-রাজবংশী, মেচ, রাভা, গারো, ধীমাল প্রমুখ ভারতের অন্যানা অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ন্যায় কৃষিকাজে অভ্যস্ত ছিল এবং এই কাজকেই তারা শ্রেয় বলে মনে করত। এরই ফলস্বরূপ চা বাগনের মালিকদের উত্তরবঙ্গের বাইরে থেকে, যেমন-ছোটোনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, নেপাল, এমনকি বাংলার ঢাকা, চট্টগ্রাম, বিহারের ভাগলপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আনতে হয়েছিল। যাইহোক, এক্ষেত্রে North Bengal State Railways (NBSR) এবং Bengal Dooars Railway (BDR)-এর বিশাল ভূমিকা ছিল। কারণ পশ্চিম ডুয়ার্সের রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, যা চা উৎপাদনকারীদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। রেলপথ চালু হওয়ার ফলে এই অঞ্চলে মাড়োয়ারি, বিহারি এবং কিছু বাঙালিদের আগমন ঘটে, এই অঞ্চলের চা উৎপাদন ব্যবস্থায় নিযুক্ত কর্মীদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহের তাগিদে গড়ে উঠেছিল। রেলওয়ে চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা জেলাজুড়ে মাড়োয়ারিরাই বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য।
উপরিউল্লিখিত এই সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ উত্তরবঙ্গের মোট জন- সংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিয়ে গঠিত অভিবাসী কর্তৃক চা উৎপাদন ব্যবস্থা উত্তরবঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নগরায়ণে সহায়তা করেছিল।
তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চলে রেলওয়ে স্টেশন, বাগানের হাট ও বাজার সব মিলেমিশে যেন এক বাগান-শহরের জন্ম দেয়, যেমন-মালবাজার, বীরপাড়া, কালচিনি, বানারহাট, মাদারিহাট, হ্যামিলটনগঞ্জ ও আরও অন্যান্য। কিছু বাগান-শহর (garden town) দার্জিলিং পাহাড়েও গড়ে ওঠে উল্লিখিত একই কারণবশত।
এইভাবে জঙ্গলাকীর্ণ উত্তরবঙ্গ বহিরাগত মানুষদের দ্বারা জনবহুল হয়ে ওঠে চা উৎপাদন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। চা উৎপাদন ব্যবস্থা এই অঞ্চলে আদি বসবাসকারীদের ওপরও যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিল। যেমন, এই নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থানীয় মেচ, ধীমালরা বেকায়দায় পড়ে যায়। জঙ্গল কেটে চা উৎপাদন অঞ্চলে পরিণত হওয়ার কারণে মেচরা তুলো উৎপাদন করতে না পারায় স্থানচ্যুত হতে শুরু করে