মহাভারতের পশ্চাদবর্তিতা :
রামায়ণ এবং মহাভারত—উভয়ই মহাকাব্য হওয়া সত্ত্বেও যে রামায়ণের তুলনায় বাঙলা ভাষায় মহাভারতের অনুবাদ বিলম্বিত হয়েছিল, তার সঙ্গেও জাতীয় জীবনের উপযােগিতার সম্বন্ধ স্বীকার করে নিতে হয়। জাতীয় জীবনে উভয় কাব্যই সমান শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত তবে পরিবেশ এবং দেশ কালের পরিপ্রেক্ষিতে এদের মূল্যমানের পরিবর্তন ঘটা স্বাভাবিক। মনােভূমি উভয়কেই সমভাবে গ্রহণে উপযােগী বা প্রস্তুত না থাকাতেই রামায়ণের অন্ততঃ শতাধিক বৎসর পর মহাভারতের অনুবাদ-প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। মহাভারতের কাহিনীগত বিস্তর জটিলতা এবং তত্তপাধান্যই সম্ভবত এজন্য দায়ী। বাঙালী জীবনে রামায়ণ ও মহাভারতের মৌলিক পার্থক্যের জন্যই মূল্যমানের পার্থক্য অনুভূত হয়েছিল।
রামায়ণে যে গার্হস্থ্য জীবনের চিত্র অঙ্কিত বা কাহিনী বিবৃত হয়েছে, বাঙালী জীবনের সঙ্গে তা অনেকাংশে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই বাঙালীর নবজাগরণ-মুহূর্তে প্রথমেই এর দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় : “রামায়ণের মহিমা রাম-রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই, সে যুদ্ধ ঘটনা রাম ও সীতার দাম্পত্য-প্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষ্য মাত্র..আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রমের যে অত্যন্ত উচ্চ স্থান ছিল, এই কাব্য তাহাই সপ্রমাণ করিতেছে।…গৃহাশ্রম ভারতবর্ষীয় আর্যসমাজের ভিত্তি। রামায়ণ সেই গৃহাশ্রমের কাব্য।”
মহাভারতের আকর্ষণ:
মহাভারতেও গৃহধর্মের চিত্র আছে, কিন্তু তাতে ক্ষাত্রধর্ম তথা বীরধর্মই প্রাধান্যলাভ করায় তা বাঙালীর প্রাণে তত সাড়া জাগাতে পারে নি। এই প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্যের অবতারণা করা চলে। সমসাময়িক হিন্দু এবং মুসলমান রাজন্যবর্গ মহাভারতের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে এর অনুবাদের উপযােগিতা উপলব্ধি করেছিলেন। ফলতঃ প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়, রাজদরবারের পৃষ্ঠপােষকতাই কবিদের মহাভারত অনুবাদে আগ্রহী করে তুলেছে। রামায়ণেও যুদ্ধকাহিনী রয়েছে, কিন্তু তা অপেক্ষাকৃত বর্বর যুগের। পক্ষান্তরে মহাভারতের যুদ্ধ যেমন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত, তেমনি এতে কূটনীতির সঙ্গেও সম্পর্ক যুক্ত রয়েছে। সমসাময়িক রাজন্যবর্গ তাই মহাভারতের যুদ্ধে স্ব-কালের চিত্রই দেখতে পেতেন। অতএব, সাধারণ বাঙালী অপেক্ষাকৃত অনাগ্রহী হলেও রাজপুরুষদের তাগিদে মহাভারতের অনুবাদ শুরু হয় এবং প্রচারও স্বভাবতঃই কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল। বাঙলা ভাষায় এই সমস্ত কারণেই মহাভারতের বিলম্বিত আত্মপ্রকাশ ঘটলেও পরবর্তীকালে অবশ্য অনুবাদের সংখ্যা খুবই বেড়ে গিয়েছিল।
মহাভারতের বৈশিষ্ট্য:
বাঙলার রাষ্ট্রীয় তথা সামাজিক অন্ধকার যুগের অবসানে জাতীয় জীবনে যখন জাগরণ-লক্ষণসমূহ প্রকট হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছিল, তখনই বাঙালী মহৎ আদর্শের অনুসন্ধানে তাকিয়েছিল প্রাচীন সাহিত্যের দিকে। এই প্রয়ােজনেই বাঙলা ভাষায় রামায়ণ মহাভারত মহাকাব্য এবং ভাগবতাদি পুরাণের অনুবাদের প্রয়ােজন দেখা দিয়েছিল। রামায়ণ-অনুবাদ কালে কবিরা যেমন সমসাময়িক যুগধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অনুবাদে অনেকখানি স্বাধীনতা গ্রহণ করেছিলেন, মহাভারত অনুবাদ কালেও তারা একই নীতি অনুসরণ করেছিলেন। মহাভারত মূলতঃ যুদ্ধপ্রধান কাব্য, যুদ্ধের প্রতি বাঙালীর স্বাভাবিক অনীহা, অতএব বাঙালী মহাভারতকে আপন স্বভাবধর্মের অনুকূল করে নিয়েছিল এবং ভক্তিধর্মের স্রোতে তাকে চালিত করেছিল। ভক্তিবাদের দেশ বাঙলায় বীররস অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভক্তিরসে পরিণত হয়েছে। বেদব্যাস সেখানে বিস্তৃতভাবে যুদ্ধোদ্যোগ এবং তার ভয়াবহতা বর্ণনা করেছেন, বাঙালী কবি সেখানে তাকে সংক্ষিপ্ত আকারে নিয়ে এসেছেন। আবার কৃষ্ণপ্রসঙ্গ পেলেই বাঙালী কবি উচ্ছসিত। যখনই বাঙালী কবি সুযােগ পেয়েছেন, সেখানেই কৃষ্ণমাহাত্ম্য প্রচার করেছেন; সুযােগ না পেলে সুযােগ সৃষ্টি করেছেন।
বাঙলা মহাভারতের নিজস্বতা: লক্ষ শ্লোকাত্মক ব্যাস-মহাভারতকে কোন কবিই আক্ষরিকভাবে অনুবাদের চেষ্টা করেন নি। বাঙলায় যুগধর্ম ও বাঙালীর স্বভাবধর্ম অনুসরণে বঙালী কবি গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে ব্যাস মহাভারতকে বাঙলা মহাভারতে পরিণত করেছেন। যুদ্ধ ও তথ্যপ্রধান রাজধর্মানুশাসন পর্ব, আপদ্ধর্ম পর্ব এবং অনুশাসন পর্ব, বাঙলা মহাভারতে বর্জিত হয়েছে। বহু কাহিনী উপকাহিনীযুক্ত মহাভারতের অনেক কাহিনীই বাঙলা মহাভারতে বর্জিত হয়েছে। আবার নতুন কাহিনীও অনেক যুক্ত হয়েছে। রুরু-প্রমদ্বরার প্রেম, বিদুলার তেজস্বিতা, উঞ্ছবৃত্তি ব্রাহ্মণের শক্তৃযজ্ঞ-আঁদি কাহিনীর বর্জন ঘটিয়ে নতুন যােগ করা হয়েছে—অকাল আম্র-বিবরণ, শ্রীবৎস-চিন্তা উপাখ্যান, জনা-প্রবীর কাহিনী, ভানুমতীর স্বয়ম্বর, লক্ষণার স্বয়ম্বর প্রভৃতি। অনুমান করা হয়, অধুনা লুপ্ত জৈমিনি-সংহিতা থেকে এই সমস্ত কাহিনী আহরণ করা হয়েছে। বাঙলা মহাভারতে ‘গীতা’র বৃহত্তম অংশ এবং ‘অনুগীতা’র সমগ্র অংশই বাদ পড়েছে।
মৌলিক রচনা: বাঙলা মহাভারতে এ ছাড়াও বহু মহাভারতীয় কাহিনীর বিকৃতি সাধন করে দেশকালাে-পযােগী করে নেওয়া হয়েছে। ব্যাসােক্ত বিভিন্ন দেশনামের পরিবর্তে বহু নতুন দেশের নাম যুক্ত হয়েছে, বহু নতুন রাজার নামও এখানে পাওয়া যায়। বাঙলা মহাভারতের। পর্ব সংখ্যা অষ্টাদশ, কিন্তু নাম ও বিন্যাসের দিক থেকে মূলের সঙ্গে পার্থক্য রয়েছে। এই সমস্ত কারণে বাঙলা মহাভারতকে মূল মহাভারতের অনুবাদরূপে গ্রহণ করা যায় না, বস্তুতঃ এতে মৌলিক কাব্যের স্বাদই বর্তমান।