কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে বর্ণিত করুণ রসের পরিচয় দাও।

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে বর্ণিত করুণ রসের পরিচয়

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ (১৬শ শতাব্দী) ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা ভাষায় “মনসামঙ্গল” কাব্য রচনা করেন, যা হিন্দু ধর্মের অন্যতম দেবী মনসার কাহিনীর ভিত্তিতে গঠিত। এই কাব্যটি একটি মঙ্গলকাব্য, যেখানে দেবী মনসার গুণগান, তাঁর শক্তি এবং ভক্তির গল্প বিবৃত হয়েছে। তবে এই কাব্যের মধ্যে যে বিশেষ কিছু উপাদান ফুটে ওঠে তা হলো—এর করুণ রস। “মনসামঙ্গল” কাব্যের মূল উপজীব্য হচ্ছে দেবী মনসার মহিমা, তবে এর মধ্যে যে করুণ রসের উপস্থিতি তা বাংলা সাহিত্য এবং কাব্যশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ এক দিক।

১. করুণ রসের সংজ্ঞা এবং এর প্রাসঙ্গিকতা

প্রথমে করুণ রসের সংজ্ঞা এবং তার কাব্যিক গুরুত্ব আলোচনা করা দরকার। ভারতীয় নান্দনিক দর্শনে (অথবা রসশাস্ত্রে), করুণ রস (শোক বা দুঃখের রস) এমন এক অনুভূতি, যা মানব মনে শোক, দুঃখ, বিষণ্নতা এবং বিপদগ্রস্ততার অনুভূতি তৈরি করে। যখন একটি কাব্য বা সাহিত্যকর্মে কোনো চরিত্র বা পরিস্থিতি শোক, দুঃখ বা দুর্দশার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে থাকে, তখন সেই কাব্যটির মধ্যে করুণ রসের প্রকাশ ঘটে। এটি সাধারণত একটি আবেগের প্রকাশ হিসেবে দুঃখের অনুভূতির উদ্রেক করে, যা শ্রোতা বা পাঠকের মধ্যে সহানুভূতি বা সহমর্মিতা জাগিয়ে তোলে।

কাব্যগুলিতে করুণ রস প্রাধান্য পেলে তা কেবল পাঠককে আবেগপূর্ণ করে তোলে না, বরং তা কাব্যের প্রধান উদ্দেশ্য বা বার্তা প্রবাহিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সুতরাং, ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের করুণ রসও কাব্যের মূল ভাবনা ও উদ্দেশ্য অনুসারে গুরুত্বপূর্ণ।

২. মনসামঙ্গল’ কাব্যে করুণ রসের সৃষ্টির উপাদান

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের “মনসামঙ্গল” কাব্যে করুণ রস সৃষ্টির অনেক উপাদান পাওয়া যায়। কাব্যটির মূল কাহিনী দেবী মনসার মহিমা এবং চাঁদ সদাগরের সঙ্গে তার বিরোধের পটভূমিতে নির্মিত। দেবী মনসা, যিনি শঙ্খচূড় দেবীর অংশ হিসেবে চিত্রিত, তাঁর পূজা এবং পূজা না করার ফলে যে শাস্তি ভোগ করেন তাতে অত্যন্ত করুণ রস সৃষ্টি হয়।

২.১. চাঁদ সদাগরের শাস্তি তার করুণ পরিণতি

কাব্যের মূল চরিত্র চাঁদ সদাগর, যিনি মনসার পূজা করতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি একাধারে এক মহান ব্যবসায়ী, যিনি পুজোর আচার আচরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। দেবী মনসা তাঁর বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেন। চাঁদ সদাগরের পরিবার, তার ব্যবসা এবং তার সমস্ত আধ্যাত্মিক অবস্থান একে একে ধ্বংস হয়ে যায়। বিশেষত, চাঁদ সদাগরের বাচ্চাদের মৃত্যু এবং তার সংসারের সর্বনাশের পরিণতি খুবই করুণ।

এর মধ্যে গভীর শোক, দুঃখ, নিষ্ঠুর পরিণতির অনুভূতি প্রকাশ পায়। চাঁদ সদাগর যখন তাঁর সন্তানদের মৃত্যুর কারণে প্রচণ্ড শোকে ভোগেন, তখন তার হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি পাঠক বা শ্রোতার মধ্যে এক গভীর করুণ অনুভূতি সৃষ্টি করে। তার অসহায়তা এবং দুর্দশা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়, যা পুরো কাব্যটিকে করুণ রসে ভরপুর করে।

২.২. সতীপুরাণ মনসার শাপে শাস্তি

এছাড়াও, দেবী মনসা যখন নিজের প্রতি অসম্মান এবং অবজ্ঞার শাস্তি দিতে চাঁদ সদাগরের পরিবারকে বিপদে ফেলে দেন, তখন সেই শাস্তি অনেক সময় অত্যন্ত কঠোর এবং শোকপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যেমন, মনসার শাপে চাঁদ সদাগরের পুত্র সন্তানরা একে একে মৃত্যুবরণ করে। চাঁদ সদাগর যখন তাঁর পুত্রদের মৃত্যু দেখে, তখন যে শোক এবং বিষাদ তার মনে সৃষ্টি হয় তা এক গভীর করুণ রসের সৃষ্টি করে। এই শোকের মধ্যে বিশেষভাবে কাব্যের হৃদয়বিদারক দিকটি ফুটে ওঠে। কাব্যের পাঠক মনোযোগী হয়ে ওঠে চাঁদ সদাগরের দুর্দশা ও অসহায়তার প্রতি, যা পরিপূর্ণভাবে করুণ রসের আবহ তৈরি করে।

২.৩. মানবিক দুঃখের অনুভূতি শ্রদ্ধা

তবে কেবল শোক বা দুঃখের ঘটনার মধ্যেই করুণ রস সীমাবদ্ধ নয়। কাব্যের অন্য একটি দিক হচ্ছে দেবী মনসার প্রতি চাঁদ সদাগরের শ্রদ্ধার প্রতিফলন। যাইহোক, চাঁদ সদাগরের শাস্তি হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত দেবী মনসার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যখন চাঁদ সদাগর তাঁর শাস্তি এবং দুঃখের পরিপূর্ণ অনুভূতি নিয়ে দেবী মনসার কাছে ক্ষমা চান, তখন তার গহীন যন্ত্রণার পাশাপাশি আত্মসমর্পণের করুণ অনুভূতি প্রকাশ পায়।

এটি মূলত একটি মানবিক দুঃখের অনুভূতি, যেখানে মানুষ শাস্তি ও দুর্দশার মাঝে গভীর এক আত্মসমর্পণ চর্চা করে। দেবী মনসা, তাঁর সহানুভূতির দ্বারা চাঁদ সদাগরকে এক নতুন জীবন দেন, যা কাব্যের একটি করুণ এবং অনুপ্রেরণামূলক দিক প্রকাশ করে। এখানে, মানবিক দুঃখের একান্ত অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে যা পরিপূর্ণভাবে করুণ রসের অভ্যন্তরীণ শ্রদ্ধাবোধ এবং সমাধানের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে।

৩. শাস্তি ক্ষমার মধ্যে করুণ রসের মিলন

“মনসামঙ্গল” কাব্যের করুণ রসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শাস্তি ও ক্ষমার মধ্যে সমন্বয়। দেবী মনসা চাঁদ সদাগরের সমস্ত প্রাপ্য শাস্তি দিয়েছিলেন, তবে তাঁর দৃঢ় ইচ্ছা এবং আত্মসমর্পণ তাকে ক্ষমা করিয়ে দেয়। চাঁদ সদাগর তার চরম দুর্দশার মধ্যেও ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং সেই মুহূর্তে কবি করুণ রসের মাধ্যমে তাঁর আবেগের গভীরতা তুলে ধরেন।

এই দুঃখময় পরিস্থিতি বা শাস্তি যেমন কাব্যের কেন্দ্রীয় করুণ রসের বাহন হিসেবে কাজ করে, তেমনি দেবী মনসার সহানুভূতির মাধ্যমে আসা মুক্তি বা ক্ষমা সম্পর্কিত অনুভূতিও করুণ রসের অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়াটি পাঠকের মনে এক দুঃখ ও শান্তির মিশ্র অনুভূতি তৈরি করে, যা কাব্যটির করুণ রসের শক্তি।

৪. উপসংহার

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের “মনসামঙ্গল” কাব্যে করুণ রসের প্রকাশ অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও গভীরভাবে রচিত। চাঁদ সদাগরের শাস্তি, তার দুর্দশা, এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমা লাভের মধ্য দিয়ে যে মানবিক দুঃখ, শোক এবং আত্মসমর্পণের অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তা কাব্যের করুণ রসের মূল উপাদান। কবি তাঁর কাব্যটি দিয়ে শুধু দেবী মনসার গৌরবই নয়, মানুষের জীবনযুদ্ধ, শাস্তি, দুঃখ ও মুক্তির সম্ভাবনাও এক সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করেছেন। “মনসামঙ্গল” কাব্যটি বাংলা সাহিত্যের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি এবং প্রাচীন রসিক সাহিত্যের একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে করুণ রসের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে।   

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading