গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে রাধাকৃষ্ণান কমিশনের সুপারিশগুলি লেখো।রাধাকৃষ্ণণ কমিশনে বর্ণিত গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা দাও।

স্বাধীনতা লাভের পর 1948 খ্রিস্টাব্দে উচ্চশিক্ষার পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন বা রাধাকৃষ্ণণ কমিশন গঠিত হয়। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে লক্ষ্য করেছিলেন , তৎকালীন মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মূলত শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাধাকৃষ্ণণ কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা করে। তৎকালীন ভারতের সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে গ্রামের গুরুত্ব উপলব্ধি করে কমিশনে শিক্ষা – ব্যবস্থাকে গ্রামজীবনের সঙ্গে সমন্বয়সাধনের কথা বলা হয়েছে।

১. পল্লি উন্নয়ন :


কমিশন লক্ষ্য করেছিল , ভারতের অধিকাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। তাদের সামগ্রিক উন্নতি ঘটাতে হলে , মুষ্টিমেয় বিত্তবান শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষা করলে চলবে না , বরং সবার আগে পল্লি উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গ্রামাঞ্চলগুলিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে। শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের উপজীবিকা , শিক্ষার মান ও সামাজিক সমস্যার পার্থক্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

২. কৃষি , জনশিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ন :


কমিশনের মতে , গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলিতে কৃষি ,উদ্যানপালন , জনশিক্ষা , গ্রামোন্নয়ন , সমাজ উন্নয়ন – প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রাধান্যলাভ করবে। কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ আছে – গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম , শিক্ষাদান পদ্ধতি ও অন্যান্য বিষয়ের পরিকল্পনা গ্রহণের সময় গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের প্রয়োজনের দিকগুলি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে।

৩. গ্রামীণ শিক্ষার রূপরেখা :


কমিশনের প্রতিবেদনে উত্তর – বুনিয়াদি বিদ্যালয়কে গ্রামীণ বিদ্যালয় হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় , কয়েকটি বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি করে একটি করে গ্রামীণ মহাবিদ্যালয় গড়ে উঠবে এবং কয়েকটি গ্রামীণ মহাবিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে।

৪. গ্রামীণ শিক্ষার বিভিন্ন স্তর :


রাধাকৃষ্ণণ কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণায় একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রামীণ শিক্ষা পরিকল্পনা উপস্থাপন করে। ওই শিক্ষা – পরিকল্পনায় চারটি স্তরের কথা বলা হয় , সেগুলি হল –
(ক ) নিম্ন ও উচ্চবুনিয়াদি শিক্ষা – 7 অথবা 8 বছর।
(খ ) উত্তর – বুনিয়াদি বা মাধ্যমিক শিক্ষা – 3 অথবা 4 বছর।
(গ ) গ্রামীণ মহাবিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষা – 3 বছর।
(ঘ ) গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষা – 2 বছর।

৫. মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আদর্শ গ্রাম গঠন :


কমিশনে উত্তর – বুনিয়াদি তথা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিকে আবাসিক করার সুপারিশ করা হয় এবং প্রতিটি উত্তর – বুনিয়াদি বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যাতে একটি আদর্শ গ্রাম গড়ে ওঠে , তার জন্য পরামর্শদন করা হয়।

৬. তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক শিক্ষার ব্যবস্থা :


উত্তর – বুনিয়াদি পর্যায়ের শিক্ষা শেষ হলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা হবে গ্রামীণ মহাবিদ্যালয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঐসকল বিদ্যালয়গুলিতে পাঠক্রমে তত্ত্বগত বৌদ্ধিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের সুযোগ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামীণ শিল্প , অর্থনীতি , সংস্কৃতি – প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণারও সুযোগ থাকবে।

৭. কর্মসূচির বিষয়ে সুপারিশ :


কমিশনে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য যেসব কর্মসূচির বিষয়ে সুপারিশ করা হয় , সেগুলির গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি দিক হল –
(i) অনুমোদনের ব্যবস্থা – বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিতে অবস্থিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলিকে অনুমোদন দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ii) আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর – মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলিকে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
(iii) পাঠক্রমে গ্রামীণ বিষয় সংযোজন – গ্রামীণ সমাজ সংস্কৃতি , শিল্প ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলিকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করা।
(iv) গ্রাম্যজীবন সম্পর্কে গবেষণা – গ্রাম্যজীবনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।
(v) তথ্য সংগ্রহ – গ্রাম্যজীবনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে তথ্যসংগ্রহের ব্যবস্থা করা।

৮. গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী অবস্থা :


1948 – 49 খ্রিস্টাব্দের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব সরকার সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন নি। তাই গ্রামীণ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভারত সরকারকে পরামর্শ প্রদানের জন্য 1956 খ্রিস্টাব্দে National Council of Rural Higher Education ( NCRHE ) গঠন করা হয়। এই কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী ভারতের বিভিন্ন স্থানে 14 – 15 টি Rural Institute গঠন করা হয়। আমাদের রাজ্যে বোলপুরের কাছে শ্রীনিকেতনে এইরূপ একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। NCRHE – র সুপারিশে গ্রামীণ অর্থনীতি , সমবায় , সমাজবিজ্ঞান ও সমষ্টি উন্নয়ন বিষয়ে পঠন – পাঠন ও ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা করার কথা বলা হলেও , বাস্তবে মাত্র কয়েকটি বিষয়ে ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্স চালু হয়। যেমন –
(i) গ্রামীণ বিজ্ঞানে সার্টিফিকেট কোর্স – 2 বছর।
(ii) কৃষিবিজ্ঞানে সার্টিফিকেট কোর্স – 2 বছর।
(iii) সিভিল ও রুরাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সার্টিফিকেট কোর্স – 3 বছর – ইত্যাদি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading