চিত্রকলার বিকাশে জাহাঙ্গীরের ভূমিকা মূল্যায়ন কর।

চিত্রকলার বিকাশে জাহাঙ্গীরের ভূমিকা:

ভারতে চিত্রকলার ইতিহাস বহুমুখী এবং অত্যন্ত বর্ণময়। এই ইতিহাসের একটি বড় অংশ মুঘল চিত্রকলার উজ্জ্বলতার মধ্য দিয়ে জ্বলজ্বল করে। প্রকৃতপক্ষে, মুঘল চিত্রকলার জন্ম এবং রাজদরবারে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং, এই বিশেষ ধারার প্রতিটি চিত্রই নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্ক এবং ইতিহাসের নির্দেশক। মুঘল চিত্রকলার বিকাশ প্রধানত পাণ্ডুলিপি চিত্রকলা এবং প্রতিকৃতি চিত্রের মাধ্যমে দেখা যায়। মুঘল চিত্রকর্মকে সাধারণত মিনিয়েচার পেইন্টিং বলা হয়। কারণ মুঘল চিত্রকলা মূলত প্রতিকৃতি আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে, ভারতে মুঘলদের প্রবেশের অনেক আগে থেকেই ভাস্কর্য চিত্রের সূচনা হয়েছিল। মুঘল চিত্রকলার ইতিহাসকে প্রধানত তিনটি যুগে ভাগ করা যায়।

১. প্রাথমিক যুগ অর্থাৎ ইন্দো-পারস্য পর্যায়।

২. স্বর্ণযুগ অর্থাৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ মুঘল চিত্রশিল্পের পর্যায় এবং

৩. অধ:পতনের যুগ।

১৬০৫ হতে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালকে মুঘল চিত্রকলার স্বর্ণযুগ বা “মুঘল রেনেসাঁ” বলা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে মুঘল চিত্ররীতির উন্মেষ কখনোই হতে পারত না। হুমায়ূনের আমদানিকৃত পারস্যরীতি আকবরের রাজত্বে ভারতীয় পরিবেশে রূপান্তরিত হলেও বিভিন্ন কারণে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বয়ংসম্পূর্ণ, সংমিশ্রিত এবং অত্যুৎকৃষ্ট চিত্রশিল্পে পরিণত হতে পারেনি। একথা অনস্বীকার্য যে, আকবরের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় মুঘল চিত্ররীতির উদ্ভব হয়, কিন্তু গুণগত দিক দিয়ে বিচার করে একে ইন্দো-পারস্য চিত্রকলা বলা হয়ে থাকে। ব্রাউন যথার্থই বলেছেন, “আকবর যে ডিম (মুঘল চিত্রকলার উন্মেষ) পাড়েন তাতে জাহাঙ্গীর তা দেন।”

আকবরের চিত্রশালায় যে শিল্পচর্চা হয়েছিল তাতে ভারতীয় এবং পারস্যরীতি ও কৌশলের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় দেখা যায় না। তার কারণ বিবিধ- প্রথমত খাজা আব্দুস সামাদ এবং মীর সৈয়দ আলীর প্রভাবে মুঘল চিত্রশালার জন্ম  এবং স্বভাবত এর প্রধান উৎস পারস্য চিত্রশিল্প। দ্বিতীয়ত আকবর এই চিত্রশালার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা লাভ করলেও জাহাঙ্গীরের মতো তাঁর দূরদর্শিতা ছিল না। তিনি মনে করতেন যে, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল হতে এবং ভারতের বাইরে থেকে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ শিল্পী সংগ্রহ করলেই উন্নতমানের শিল্প সৃষ্টি সম্ভব। উপরন্তু, চিত্রকরদের প্রয়োজনে তিনি রাজকীয় গ্রন্থাগারে অসংখ্য চিত্রিত ফারসী পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করেন; সুতরাং স্বভাবত শিল্পীগণ অসংখ্য পারস্য চিত্ররীতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন।

অপরদিকে হিন্দু চিত্রকরদের সংখ্যাধিক্য থাকায় তাঁরা স্বাধীনভাবে ভারতীয় রাজপুতরীতিতে চিত্রাঙ্কন করতেন; এই কারণে ভারতীয় ও পারস্যরীতির সংমিশ্রণ সম্ভবপর হয়নি। তৃতীয়ত একটি চিত্রে একাধিক চিত্রশিল্পী নিয়োগের ফলে বিভিন্ন চিত্রধারায় অভিজ্ঞ শিল্পীদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অভিব্যক্তিতে একটি বিরাট বৈষম্য দেখা যায়; অর্থাৎ একজন পারস্যরীতিতে স্কেচ, অপর একজন ভারতীয় রীতিতে প্রতিকৃতি অঙ্কন এবং তৃতীয়জন পারস্য কৌশলে রঙের প্রয়োগ করলে স্বভাবত শিল্পগত গুণাবলী ব্যাহত হয়। চতুর্থত আকবর তাঁর সুযোগ্য এবং শিল্পানুরাগী পুত্র জাহাঙ্গীরের মতো শিল্পচর্চায় ব্যক্তিগত প্রভাব প্রদর্শন করেননি।

শিল্পকলা একাডেমীর অধ্যক্ষের উপর চিত্রকলার উৎকর্ষ নির্ভর করায় প্রকৃত মুঘলরীতির আবির্ভাব ব্যাহত হয়েছে। আব্দুস সামাদের নিকট চিত্রকলায় শিক্ষালাভ করলেও জাহাঙ্গীরের মতো তিনি শিল্পমনা ছিলেন না। জাহাঙ্গীরের নির্দেশে অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল এবং তিনি যুদ্ধাভিযানেও চিত্রকরদের সাথে নিয়ে যেতেন। পঞ্চমত পারস্যরীতিতে আকবরের আমলে পান্ডুলিপি চিত্রায়ণ হয় এবং এই কারণে বিচ্ছিন্ন মিনিয়েচরের মাধ্যমে মুঘলরীতির পরিস্ফুটন সম্ভবপর হয়নি। যুবরাজ দানিয়েল বলেন, “শিরিন এবং ফরহাদের প্রেমের উপাখ্যান পুরাতন হয়ে গেছে এবং যখন আমরা পড়ি তখন পূর্বে আমরা যা দেখেছি এবং শুনেছি তা অপেক্ষা কোনো নতুনত্ব নেই।” জাহাঙ্গীরের পৃষ্ঠপোষকতায় মিনিয়েচর অঙ্কন হ্রাস পায়, কারণ শিল্পী পান্ডুলিপির ঘটনাবলী অপেক্ষা জীবন্ত চাক্ষুষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একক ও বিচ্ছিন্ন চিত্র অঙ্কনে মনোনিবেশ করেন। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, প্রতিকৃতি অঙ্কনের রীতি মুঘল চিত্রকলাকে পান্ডুলিপি-চিত্রাবলী হতে মুক্ত করেছে।

জাহাঙ্গীরের সিংহাসনারোহণ মুঘল চিত্রকলার ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। জাহাঙ্গীর নিজেও শিল্পী ছিলেন এবং চিত্রকরেরা তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব, শিল্পানুরাগ এবং একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পচর্চা করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ইন্দো-পারস্যরীতি বিলুপ্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ মুঘলরীতির রূপান্তর সম্ভবপর হয়েছিল প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, জাহাঙ্গীরের শিল্পানুরাগ এবং শৈল্পিক ব্যক্তিত্ব এবং দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।

আকবর যুদ্ধবিগ্রহে এত ব্যস্ত ছিলেন এবং বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তাঁকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে ব্যক্তিগত প্রভাব, নির্দেশনা অথবা অভিব্যক্তির প্রকাশ শিল্পের মাধ্যমে সফলকাম হয়নি। তিনি অসংখ্য শিল্পী সংগ্রহ করেছিলেন কিন্তু তাঁদের শিল্পচর্চায় সুষ্ঠু সামঞ্জস্যবিধান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না; কারণ জাহাঙ্গীরের মতো তাঁর দূরদর্শিতা, শিল্পানুভূতি এবং সংবেদনশীল মন ছিল না। জাহাঙ্গীরের রাজত্বে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় ছিল এবং এই কারণে অবিরাম ও উন্নতমানের শিল্পচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

জাহাঙ্গীরের শিল্পানুরাগ এবং চিত্রকলায় অবদান সম্বন্ধে প্রধানত তাঁর আত্মচরিত হতে সঠিক তথ্য জানা যায়। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি একটি সুসংঘবদ্ধ বিশাল সাম্রাজ্যই লাভ করেন নি বরং স্বীয় শিল্পানুভূতির বহিঃপ্রকাশস্বরূপ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অত্যুৎকৃষ্ট চিত্রশালাও পিতার নিকট হতে পেয়েছিলেন। যুবরাজ হিসেবে তিনি প্রথম যুগের শিল্পচর্চায় আকৃষ্ট হন এবং আবুল ফজল রচিত ‘আকবরনামা’র চিত্রিত পান্ডুলিপিতে উল্লেখ আছে যে, ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীর উক্ত গ্রন্থখানি রাজকীয় গ্রন্থাগারে অর্পণ করেন।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading