জাপানি সামরিকবাদের বৃদ্ধির কারণগুলি:
ভূমিকা: জাপানের সামরিক বাহিনী দীর্ঘকাল ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে, ১৮৬৮ সালের মেইজি পুনরুদ্ধারের পর থেকে, বিশেষ করে ২০শ শতাব্দীতে, জাপানি সামরিকবাদের একটি বিপুল বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। এটি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিতে পরিবর্তন ঘটিয়েছে, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সমগ্র বিশ্ব রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
জাপানি সামরিকবাদের বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামাজিক কারণ ছিল, যা একে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা জাপানি সামরিকবাদের বৃদ্ধির পিছনে থাকা প্রধান কারণগুলির বিস্তারিত বিশ্লেষণ করব।
১. মেইজি পুনরুদ্ধার এবং আধুনিক সামরিক শক্তির চাহিদা:
১৮৬৮ সালের মেইজি পুনরুদ্ধারের পর, জাপান শোগুনেটের শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে আধুনিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। মেইজি সরকার দেশের আধুনিকায়ন এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য বিদেশী প্রযুক্তি এবং সামরিক কাঠামো গ্রহণ করে। মেইজি পুনরুদ্ধারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের আধুনিকীকরণ, যা সব দিকেই, বিশেষত সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছিল।
- পশ্চিমী শক্তির প্রতি প্রতিরোধ: জাপান পশ্চিমী শক্তিগুলির অগ্রগতিকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। চীন এবং কোরিয়া, যাদের ওপর পশ্চিমী শক্তির আগ্রাসন দেখা যাচ্ছিল, জাপান তাদের দ্বারা সংক্রমিত হতে চায়নি। এজন্য মেইজি সরকার দ্রুত একটি আধুনিক সামরিক বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিল, যা জাপানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হবে।
- নতুন সামরিক কাঠামো এবং প্রশিক্ষণ: মেইজি সরকার, বিশেষত প্রধান উপদেষ্টা, ফ্রেডরিক মেলচিওর কটরেটের নেতৃত্বে, পশ্চিমী দেশের সামরিক কৌশল এবং প্রযুক্তি শিখতে শুরু করে। জাপান প্রুশিয়া (বর্তমান জার্মানি) এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ করে এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, জাহাজ, রেলওয়ে এবং টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মেইজি সরকার সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করতে থাকে।
২. সাম্রাজ্যবাদী নীতি এবং উপনিবেশিক সম্প্রসারণ:
১৯শ শতকের শেষে এবং ২০শ শতকের শুরুতে, জাপান একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে শুরু করে। এই সময়ে, পৃথিবীজুড়ে উপনিবেশিক প্রতিযোগিতা চলছিল এবং জাপানও তার নিজস্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করেছিল।
- চীনের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা: ১৮৯৪-১৮৯৫ সালের চীনা-জাপানি যুদ্ধের ফলে জাপান কোরিয়া এবং তাইওয়ানকে অধিকার করে। এই যুদ্ধ ছিল জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রথম বড় পদক্ষেপ। জাপান যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের সামরিক শক্তি এবং রাজনৈতিক কৌশল প্রমাণ করতে সক্ষম হয়।
- রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত: ১৯০৪-১৯০৫ সালের রুশ-জাপানি যুদ্ধও জাপানকে একটি শক্তিশালী সামরিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে, জাপান রাশিয়াকে পরাজিত করে এবং মাঞ্চুরিয়া ও কোরিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই বিজয় জাপানের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় এবং সামরিক বাহিনীর গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে।
৩. সামরিক মনোবৃত্তি এবং জাতীয়তাবাদ:
জাপানীয় সমাজে সামরিক মনোবৃত্তি এবং জাতীয়তাবাদ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা সামরিক বাহিনীর শক্তির বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল।
- যুদ্ধকালীন সংস্কৃতি: জাপানে যুদ্ধের প্রতি এক বিশেষ ধরনের শ্রদ্ধা ছিল, যেখানে “শহীদ হওয়া” একটি সম্মানজনক বিষয় হিসেবে দেখা হত। জাপানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাঝে আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, এবং সম্মানবোধ জোরালোভাবে বিদ্যমান ছিল। এই মনোবৃত্তি সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত করে তুলেছিল।
- জাতীয়তাবাদ ও সামরিক সরকার: ১৯৩০-এর দশক থেকে, জাপানে জাতীয়তাবাদী মনোভাব আরও দৃঢ় হতে থাকে, যা সামরিক বাহিনীকে সরকারীভাবে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে সম্মানিত করে তোলে। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা প্রচারে এগিয়ে যাওয়া, দেশটির রাজনৈতিক চিন্তা ও সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
৪. অর্থনৈতিক চাহিদা ও সামরিক শিল্প:
সামরিক শক্তির বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল জাপানের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং শিল্পায়ন। মেইজি পুনরুদ্ধারের পর, জাপান তার শিল্প, বিশেষত ভারী শিল্পে দ্রুত এগিয়ে যায়। সামরিক বাহিনী এবং শিল্পের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল।
- বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতা: জাপান বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে এবং তার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কাঁচামাল, শ্রমশক্তি এবং বাজারের জন্য সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছিল জাপানের সামরিক মনোভাবের অংশ।
- ভারী শিল্পের বিকাশ: ১৯১০-এর দশকে, জাপানে ভারী শিল্প, যেমন স্টিল, অটোমোবাইল, মেশিনারি এবং নৌযান শিল্পের বিকাশ ঘটে। এই শিল্পগুলো সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটি সামরিক সরঞ্জাম, অস্ত্র, এবং রণতরী তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।
৫. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং যুদ্ধপ্রবণ নীতি:
জাপান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আগ্রাসী এবং শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে চেয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, জাপান তার সামরিক শক্তি আরও বৃদ্ধি করে এবং বিশ্বব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি আগ্রাসী সামরিক নীতি গ্রহণ করে।
- চীনে আগ্রাসন: ১৯৩৭ সালে দ্বিতীয় চীনা-জাপানি যুদ্ধ শুরু হয়, যেখানে জাপান চীনের বিভিন্ন অংশে আগ্রাসন চালায়। এটি ছিল জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতির একটি বড় অংশ, যেখানে জাপান তার সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে চীনের অভ্যন্তরীণ সংকটে হস্তক্ষেপ করে।
- পার্ল হারবার আক্রমণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর, জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার নৌঘাঁটিতে আক্রমণ করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। এই আক্রমণের ফলে, জাপান সামরিক শক্তির মাধ্যমে বিশ্বযুদ্ধের একটি প্রধান শক্তি হিসেবে পরিণত হয়।
উপসংহার:
জাপানের সামরিক বাহিনীর বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ ছিল—মেইজি পুনরুদ্ধারের সময় আধুনিক সামরিক বাহিনী গঠন, সাম্রাজ্যবাদী নীতি, জাতীয়তাবাদী মনোভাব, অর্থনৈতিক এবং শিল্প উন্নয়ন, এবং আন্তর্জাতিক আগ্রাসী নীতির ফলস্বরূপ। সামরিক শক্তির বৃদ্ধির কারণে, জাপান তার আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তার এবং সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্যগুলি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে, এই সামরিক প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, যা জাপানের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছিল।