তেভাগা আন্দোলনের কারণ ও তাৎপর্য আলোচনা করো। (Discuss the causes and significance of Tebhaga Movement.)

তেভাগা আন্দোলন ছিল মূলত শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। কৃষিনির্ভর ভারতবর্ষ হলেও বেশিরভাগ কৃষক ছিল ভূমিহীন। যার ফলে, তারা কোনো জমিদার বা জোতদারের অধীনে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করত। ভারতীয় উপমহাদেশে যুগ যুগ ধরে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন ও শোষণের শিকার হয়েছে কৃষক বা বর্গাচাষিরা।

তেভাগা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়েছিল 1793 সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে। এই আন্দোলনের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটা পরোক্ষ এবং সূক্ষ্ম যোগসূত্র রয়েছে। 1793 সালে ব্রিটিশ গভর্নর কর্নওয়ালিস কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর পর থেকে বাংলার কৃষকেরা একের পর এক জমির মালিকানা হারাতে থাকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। কৃষকেরা জমির মালিকানা হারিয়ে পরিণত হয় ভাড়াটে মজুরে বা বর্গাচাষিতে। এদিকে কৃষক ও জমিদারদের মাঝখানে জোতদার নামে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে কৃষকদের দিয়ে চাষ করত এবং খাজনা আদায় করত।

তেভাগা আন্দোলনের কারণ হিসেবে বলতে হয়, প্রাচীনকাল থেকেই উপমহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের সমৃদ্ধির পিছনে কৃষকদের অবদান থাকলেও কৃষকদের সমৃদ্ধি কখনোই হয়নি। ভারতবর্ষে কৃষক সম্প্রদায় মূলত নিঃস্ব হতে থাকে ব্রিটিশ আমল থেকেই। ব্রিটিশদের অধীনে জমিদার এবং ভূস্বামীগণ লাভবান হলেও কৃষকরা ছিল অবহেলিত। তা ছাড়া কৃষকরা ছিল ভূমিহীন। তারা কোনো জমিদার বা ভূস্বামীর জমি বর্গাচাষ করে জীবনযাপন করত। কিন্তু অন্যের জমি চাষ করে ভূমিহীন কৃষক বা বর্গাচাষিরা উৎপন্ন ফসলের মাত্র অর্ধেক বা আরও অনেক কম পেত, অথচ ফসল ফলানোর জন্য বীজ থেকে শুরু করে প্রায় সকল প্রকার আর্থিক ও শারীরিক শ্রম দিতে হত কৃষকদের। বছরের পর বছর এভাবে মাত্রাতিরিক্ত শোষণ-নিপীড়নে এক সময় শোষিত বর্গাচাষিরা আন্দোলনের ডাক দেয়। 1946 সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়ে 1947 সাল পর্যন্ত চলে এই আন্দোলন।

আন্দোলনে ভূমিহীন কৃষকদের দাবি ছিল, উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে জমির মালিক আর দুই ভাগ পাবে কৃষক। তিন ভাগের একভাগ অর্থাৎ তেভাগা থেকেই এই আন্দোলনের নাম হয় তেভাগা আন্দোলন। 1946 সালে এই আন্দোলন শুরু হয়ে পূর্ববলা ও পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের সঙ্গে কৃষক সমাজ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে।

মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দু-ভাগ পাবে চাষি, একভাগ জমির মালিক- এই দাবি থেকে মূলত তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তেভাগা আন্দোলনের একজন অগ্রদূত মহিলা ছিলেন ইলা মিত্র। সাঁওতালদের কাছে যিনি ‘রানিমা’ নামে পরিচিত। 1950 সালের 7 জানুয়ারি, তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি রোহনপুরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার অবস্থায় পুলিশের বর্বর পৈশাচিক নির্যাতনের শিকারও হন ইলা মিত্র। 1946-47 সালে দুই বাংলায় 19টি জেলায় তেভাগা আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঘটেছিল। সকল সাম্প্রদায়িকতা ও বিবাদকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিখিল ভারত কৃষক সভার নেতৃত্ব হিন্দু-মুসলমান সকলে এক ভ্রাতৃত্বের ছায়ায় এসেছিল, যার ফলে দুই বাংলায় তীব্রতা লাভ করে তেভাগা আন্দোলন।

তেভাগা আন্দোলন দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, পাবনা, ফরিদপুর, হাওড়া, হুগলি, মালদা, বাঁকুড়া, নদীয়া, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি জেলায় সংগঠিত হয়। তবে দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোর এবং চব্বিশ পরগনা জেলায় এই আন্দোলনের সর্বাধিক তীব্রতা অনুভূত হয়। প্রায় 60 লক্ষ বর্গাচাষি এই আন্দোলনে অংশ নেয়। দিনাজপুর জেলার তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল তেভাগা আন্দোলনের মূল সূতিকাগার। তৎকালীন দিনাজপুরের 30টি থানার মধ্যে 22টি থানাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনের প্রভাব। দিনাজপুরে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন হাজি মহম্মদ দানেশ। আন্দোলনের প্রথমদিকে জমিদার শ্রেণি পুলিশ, লাঠিয়াল বাহিনী, মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে দমনের চেষ্টা চালায় কিন্তু তাদের হার মানতে হয় নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য দাবির কাছে। 1946 সাল থেকে 1947 সাল পর্যন্ত চলে তেভাগা আন্দোলন।

তেভাগা আন্দোলন বিংশ শতাব্দীতে উপমহাদেশের দরিদ্র কৃষক এবং উপজাতীয় বর্গাচাষিদের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশকে প্রতিফলিত করেছিল। এই আন্দোলনের ফলাফল বা প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তেভাগা আন্দোলন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গে এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, কৃষকেরা সেসব অঞ্চলকে তেভাগা এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে এবং স্থানীয়ভাবে এলাকার শাসনের জন্য তেভাগা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। 1947 সালের 22 জানুয়ারি, সরকার আন্দোলনের চাপে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিধানসভায় ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল’-1947 উত্থাপন করে। দীর্ঘ 46 বছরের দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এড়িয়ে এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান সমানভাবে অংশগ্রহণ করে। জমির মালিকরা তেভাগা আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের সঙ্গে চুক্তি করে। জমিদার বা ভূস্বামীগণ প্রায় 40 ভাগ বর্গাচাষিকে স্বেচ্ছায় তেভাগা দেয়। এ ছাড়া খাজনার নামে বলপূর্বক অর্থ আদায় বন্ধ বা সীমিত করা হয়। 1950 সালের ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন 1950’ বিলের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটে। বিনয় চৌধুরীর নেতৃত্বে, 2.4 মিলিয়ন উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading