পাল বংশ যে সময়ে বাংলা ও বিহারে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। সেসময়ে উত্তর ভারতের মধ্যস্থলে তেমন কোনো প্রভাবশালী শক্তি ছিল না। আর্যাবর্তের কেন্দ্রস্থলে কাম্বকুজে তখন রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করেছিল। এই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে প্রায় তিন পুরুষ ধরে পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে প্রচ উৎসাহ ও প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। মালব ও রাজস্থানের গুর্জর ও প্রতিহার, দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজাগণ এবং বাংলার পাল রাজাগণ প্রায় একই সময়ে মধ্যদেশ অধিকার বিস্তালে প্রয়াসী হন। ফলে এক ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস এটিই ‘ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ’ নামে পরিচিত।
অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। অনুমান করা হয় 790 খ্রিস্টাব্দ বা নিকটবর্তীকালে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের প্রথম পর্যায় সংঘটিত হয়েছিল। এই পর্যায়ের সূত্রপাত হয় প্রতিহার ও পাল সংঘর্ষে। ধর্মপাল যে সময়ে পশ্চিমদিকে বিজয়াভিযান করেন, সে সময় প্রতিহার রাজা বৎসরাজও মধ্যদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টায় পূর্বদিকে অগ্রসর হন। ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এ যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন। কিন্তু বৎসরাজ মধ্যদেশে অধিকার করার আগেই তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটে। দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকুট রাজা হুধারাবর্ষ এ সময়ে আর্যাবর্তে বিজ্ঞয়াভিযানে আসেন। তিনি বৎসরাজকে পরাজিত করে ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়ে ধর্মপাল উভয় শক্তির কাছে পরাজিত হলেও তাঁর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ ধ্রুব তাঁর বিজ্ঞয় সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না করেই দাক্ষিণাত্যে প্রত্যাবর্তন করেন। এতে ধর্মপাল পরাজিত হয়েও ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ পান। এর কারণ খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, বৎসরাজ পরাজয়ের পর প্রতিহারদের পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল। তাই ধ্রুবের প্রত্যাবর্তনের পর ধর্মপাল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ধর্মপাল কাম্বকুজে তাঁর প্রতিনিধি বসাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর প্রমাণ রয়েছে নারায়ণপালের ভাগলপুর তাওলিপির একটি শ্লোকে। সেখানে বলা হয়েছে ধর্মপাল ইন্দ্রেরাজকে পরাজিত করে মহোদয় (কাম্বকুন্ডে) অধিকার করেন এবং চক্রায়ুধকে শাসনভার অর্পণ করেন। ধর্মপালের খালিমপুর তাওলিপিতে এই ঘটনার সমর্থন পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ আছে “তিনি মনোহর শুভশী বিকাশে (চোখের ইঙ্গিত দ্বারা) কাম্বকুক্তে রাজ অভিষেক সম্পন্ন করেছিলেন। ভোজ, মৎস্য, মন্ত্র, কুরু, যদু, পবন, অবন্তী, গান্ধার এবং ক্ষীর প্রভৃতি রাজ্যের নরপালগণ প্রগতিপরায়ণ চঞ্চল মস্তকে সাধু সাধু বলে এর রমর্থন করেছিল এবং হৃষ্টচিত্তে পাঞ্চালদেশের বৃদ্ধগণ কর্তৃক তাঁর অভিষেকের স্বর্ণকলস উগ্রত করেছিলেন।”
উড়া রামপাল কনৌজ অধিকার করে স্বীয় প্রতিনিধি চক্রায়ুধকে সেখানে অধিষ্ঠিত উকরেছিলেন। কারণ রাষ্ট্রকুট ও প্রতিহার উৎসসমূহে এর সমর্থন পাওয়া যায়। তবে পাল ভদ্রমূহে রামপালের এই জয় অনেকটা অতিরঞ্জিত বলে অনেক ঐতিহাসিকরা মনে উতলিমপুর তান্ড প্রশস্তিতে যে অন্যান্য রাজন্যবর্গের বর্ণনা আছে তা কতটা সত্য কল্পনাপ্রসূত, তা বলা কঠিন। তবে যাই হোক কনৌজের সাফল্য বাংলার ইতিহাসে উরগরিবের কথা নয়।কনৌজে ধর্মপালের আধিপত্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রতিহার রাজা বৎসরাজেরে পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট নতুন মৈত্রীর মাধ্যমে আবার স্বীয় রাজ্যের শক্তি বাড়াতে সক্ষম হন। প্রতিহার উৎসে দাবি করা হয়েছে, দ্বিতীয় নাগভট্ট চক্রায়ুধকে পরাজিত করেন। গোয়ালিয়র প্রশস্তি হতে জানা যায় যে, ধর্মপালের বিপুল সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও নাগভট্ট তাঁকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। অন্য এক লিপিতে উল্লেখ রয়েছে যে, এই যুদ্ধ মুঙ্গের (পাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল) বা নিকটবর্তী কোনো স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। এতে এটি স্পষ্ট হয় যে, নাগভট্ট পশ্চাদদ্ধাবযান চক্রায়ুধকে অনুসরণ করেন মুঙ্গের পর্যন্ত এসেছিলেন। অন্যদিকে চক্রায়ুধ স্বাভাবিক কারণেই তাঁর অধিকর্তার নিকট আশ্রয় পাওয়ার জন্য পাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলের দিকে এসেছিলেন। কিন্তু এরপরেও প্রতিহার রাজ মধ্য ভারতে ক্ষমতা বিস্তারে ব্যর্থ হন। কেননা এ সময়ে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারতে আগমন করেন এবং নাগভট্রকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। নাগভট্টের পরাজয়ের পর ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ উভয়েই স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রকূট রাজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এ থেকে মনে করা যায় যে. গোবিন্দ ধর্মপালের আহবানেই উত্তর ভারতে এসেছিলেন। তবে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রমান্ত নেই। পিতার ন্যায় গোবিন্দকেও আনুমানিক ৪01 খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যেতে হয়েছিল।
গোবিন্দের প্রত্যাবর্তের পর কনৌজের অবস্থা কী হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে যে, ধর্মপাল আবার সেখানে তাঁর প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন। তবে প্রমাণের এমন কথাও তেমন জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে 836 খ্রিস্টাব্দে কনৌজ হতে প্রতিহার রাজ ভোজের লিপি উদ্ধার হয়। সুতরাং বলা যায়, ৪০। খ্রিস্টাব্দ হতে 836 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে কনৌজ প্রতিহারদের হাতে যায় এবং ভোজ মধ্যদেশে প্রতিহার সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। অন্যদিকে দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে, দেবপালের সিংহাসন আরোহণকালে রাজ্যে কোনো প্রকার বিপদ ছিল না। অর্থাৎ, গোবিন্দের প্রত্যাবর্তনের পর ধর্মপাল আবার কোনো বিপদের সম্মুখীন হননি বলেই মনে করা হয়।
ধর্মপালের মৃত্যুর পর পাল বংশের রাজা হন তাঁর পুত্র দেবপাল। দেবপালের আমলে ত্রিদলীয় সংগ্রামের তীব্রতা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছিল। রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় গোবিন্দের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকূট রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রাষ্ট্রকূট রাজ প্রথম অমোঘবর্ষ ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন দুর্বল। দ্বিতীয় নাগভট্টের পরবর্তী প্রতিহার রাজ রামভট্ট ছিলেন একজন শান্তিকামী শাসক। অন্যের রাজ্য আক্রমণের দিকে তাঁর কোনো স্পৃহা ছিল না। পাল রাজা দেবপালও নতুন করে ত্রিদলীয় সংগ্রামকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাননি, বরং এ সুযোগে তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতে রাজ্যবিস্তারে মন দিয়েছিলেন। ক্রমে উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারে ত্রিদলীয় সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে।তবে সমসাময়িক সূত্র থেকে জানা যায়, দেবপাল প্রতিহার রাজা ভোজকে পরাজিত করেছিলেন। তা ছাড়া রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গেও দেবপাল জয়লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। মুঙ্গের লিপিতে উল্লেখ আছে, দেবপাল পান্ডুর রাজা শ্রীবল্লভকে পরাজিত করে দক্ষিণ ভারতের সেতুবন্ধ রমেশ্বর পর্যন্ত সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এই বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান। তাঁরা মনে করেন, দেবপাল যে দাক্ষিণাত্যে সমরাভিযান চালিয়েছিলেন সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। দীর্ঘকাল ধরে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকার ফলে পাল, প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট তিন শক্তিরই সৈন্য ও অর্থক্ষয় ঘটে। বিপুল পরিমাণে ব্যয় সামলাতে প্রজাদের ওপর করের বোঝা বাড়াতে বাধ্য হয় রাজারা। এ ছাড়া তিন শক্তির দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে পরবর্তীকালে সামন্তরাজারা স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছায় আগ্রহী হয়ে পড়ে। তবে তিন শক্তির মধ্যে কেউই দীর্ঘ সময়ের জন্য কনৌজ তথা উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারের সক্ষম হয়নি।