প্রশ্নাবলার সংজ্ঞা এবং জরিপ গবেষণায় এর গুরুত্ব:
প্রশ্নাবলার সংজ্ঞা:
প্রশ্নাবলার (Questionnaire) একটি গবেষণামূলক সরঞ্জাম যা সাধারণত ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত একটি লিখিত ফর্মে থাকে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন থাকে, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা বিষয়ের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রশ্নাবলার একটি শ্রেণিবদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে যেকোনো গবেষণার বিষয়বস্তু, আচরণ, মনোভাব, অথবা কোনো বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এটি বিশেষত সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, এবং অন্যান্য সামাজিক গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
প্রশ্নাবলার সাধারণত দুই ধরনের হতে পারে: একে বলা হয় বন্ধ (Closed) বা খোলা (Open) প্রশ্নাবলার।
- বন্ধ প্রশ্নাবলার: যেখানে উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু অপশন থাকে। যেমন, হ্যাঁ/না বা বিভিন্ন বিকল্পের মধ্যে একটি নির্বাচন।
- খোলা প্রশ্নাবলার: যেখানে উত্তর দাতা তার নিজের ভাষায় উত্তর প্রদান করে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো অপশন থাকে না, এবং এটি এক ধরনের মুক্ত উত্তর সংগ্রহের পদ্ধতি।
প্রশ্নাবলারগুলি সাধারণত সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হয়, যাতে গবেষকরা প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন এবং গবেষণার লক্ষ্য অনুযায়ী ফলাফল প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
প্রশ্নাবলার নকশা এবং জরিপ গবেষণার ফলাফল:
প্রশ্নাবলার নকশা বা ডিজাইন একটি জরিপ গবেষণার ফলাফলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সঠিকভাবে পরিকল্পিত প্রশ্নাবলার গবেষণার লক্ষ্য সফলভাবে অর্জন করতে সাহায্য করে, এবং এর মাধ্যমে সরবরাহকৃত তথ্য নির্ভুল এবং উপযুক্ত হতে পারে। অপরদিকে, দুর্বলভাবে ডিজাইন করা প্রশ্নাবলার ভুল, অস্পষ্ট, অথবা বিভ্রান্তিকর ফলাফল সৃষ্টি করতে পারে, যা গবেষণার মান এবং নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
প্রশ্নাবলার নকশার মাধ্যমে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত হয়:
১. প্রশ্নের স্পষ্টতা এবং পরিসর:
প্রশ্নাবলার নকশায় প্রথম এবং প্রধান বিষয় হলো প্রশ্নগুলির স্পষ্টতা। সঠিকভাবে নির্মিত প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট উত্তরদাতাদের জন্য পর্যাপ্ত এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করা সহজ হয়। যদি প্রশ্নগুলির মধ্যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি থাকে, তাহলে গবেষক হয়তো ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য পাবেন, যা জরিপের ফলাফলকে বিকৃত করতে পারে।
উদাহরণ:
- যদি কোনো প্রশ্নে শব্দ বা ভাষার জটিলতা থাকে, যেমন “আপনি কি পরিবেশ সচেতন?” – এটি প্রশ্নাবলার জন্য অনেকটাই অপ্রীতিকর হতে পারে কারণ অনেকেই জানেন না ‘পরিবেশ সচেতন’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে। এই ধরনের প্রশ্নের ফলস্বরূপ নানা ধরনের ভুল তথ্য বা অপূর্ণ উত্তর আসতে পারে।
২. প্রশ্নের ধরণ এবং বৈচিত্র্য:
প্রশ্নাবলার নকশায় বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন ব্যবহার করা হতে পারে, যেমন:
- বহু বিকল্প প্রশ্ন (Multiple Choice): এই ধরনের প্রশ্নে গবেষকরা বিভিন্ন বিকল্প প্রদান করেন, যার মধ্যে থেকে উত্তরদাতাকে এক বা একাধিক সঠিক উত্তর নির্বাচন করতে হয়।
- মান বিচিত্র প্রশ্ন (Likert Scale): এটি একটি ৫ বা ৭ পয়েন্টের স্কেল, যেখানে উত্তরদাতারা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি তাদের মতামত (যেমন, একেবারে অসম্মতি থেকে একেবারে সম্মতি) প্রদান করেন।
- তারিখ প্রশ্ন (Date Questions): কোনও নির্দিষ্ট সময় বা তারিখ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
- গণনা বা মাপ প্রশ্ন (Numerical or Quantitative Questions): যেখানে কিছু সংখ্যা বা মাপ সম্পর্কে তথ্য জানতে চাওয়া হয়।
এই ধরনের প্রশ্নগুলির কাঠামো এবং বৈচিত্র্য জরিপের ফলাফলে বিশাল প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, যদি গবেষক শুধুমাত্র বন্ধ প্রশ্ন ব্যবহার করেন, তাহলে উত্তরদাতার মতামত বা চিন্তা পুরোপুরি নির্দিষ্ট অপশনগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে, কিন্তু খোলা প্রশ্ন ব্যবহার করলে গবেষক বিস্তারিত ও স্পষ্ট তথ্য পেতে পারেন।
৩. প্রশ্নের ভাষার ধরন:
প্রশ্নাবলার নকশার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভাষার ধরন। যদি প্রশ্নাবলার ভাষা খুবই কঠিন, জটিল, অথবা অস্পষ্ট হয়, তাহলে উত্তরদাতা সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারবেন না। প্রশ্নের শব্দের নির্বাচনে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তা সহজ, স্পষ্ট এবং সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত হয়।
যেমন:
- “আপনি কি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক নীতি মেনে চলেন?” – এই ধরনের জটিল প্রশ্নের বদলে, সাধারণত: সহজ ভাষায় প্রশ্ন করা উচিত, যেমন: “আপনি কি মনে করেন যে, সরকারকে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে উচিত?”
৪. নমুনার প্রতিনিধিত্বযোগ্যতা এবং নমুনা নির্বাচন:
প্রশ্নাবলার নকশায় যদি নমুনা সঠিকভাবে নির্বাচিত না হয়, তাহলে তা গবেষণার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। একটি সম representative নমুনা নির্বাচন করা জরুরি, যাতে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বৈচিত্র্য থাকে এবং তাদের থেকে সংগৃহীত তথ্য সঠিকভাবে সাধারণীকৃত হতে পারে। প্রশ্নাবলার ডিজাইনে যাতে নমুনার বৈচিত্র্য এবং প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, তাও গুরুত্বপূর্ণ।
৫. উত্তরদাতার মনোভাব এবং আচরণ:
প্রশ্নাবলার ডিজাইন করার সময় গবেষকদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, প্রশ্নের ভাষা এবং কাঠামো উত্তরদাতাদের মনোভাব এবং আচরণকে প্রভাবিত না করে। অর্থাৎ, প্রশ্নের এমন কোনও কাঠামো বা ভাষা ব্যবহার করা যাবে না, যা উত্তরদাতাকে একদিকে ঝুঁকিয়ে দিতে পারে বা কোন পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করতে পারে।
যেমন, “আপনি কি মনে করেন যে নারীদের জন্য সরকারি সহায়তা জরুরি?” – এই ধরনের প্রশ্ন কিছুটা পক্ষপাতিত্বপূর্ণ হতে পারে, যেহেতু প্রশ্নের ভাষা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৬. সমীক্ষা পরিচালনার সময়কাল এবং প্রশ্নের গঠন:
গবেষণার সময়কাল এবং প্রশ্নের সঠিক গঠন জরিপের ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে। যদি প্রশ্নাবলার প্রশ্নগুলো অনেক দীর্ঘ এবং জটিল হয়, তবে উত্তরদাতাদের জন্য সেগুলোর উত্তর দেওয়াটা কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। একইভাবে, দীর্ঘ সময় ধরে চলা জরিপও উত্তরদাতাদের ক্লান্ত এবং অসন্তুষ্ট করে দিতে পারে, যার ফলস্বরূপ প্রাপ্ত তথ্যের গুণমান কমতে পারে।
প্রশ্নাবলার নকশার প্রভাব:
১. গবেষণার মান এবং নির্ভরযোগ্যতা:
প্রশ্নাবলার ডিজাইনে যতটা যত্ন নেওয়া হবে, তত বেশি তা গবেষণার মান ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। স্পষ্ট, নির্ভুল এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রশ্নাবলার একটি গবেষণার ফলাফলকে যথার্থ করে তোলে।
২. অশুদ্ধ বা পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ফলাফল:
যদি প্রশ্নাবলার খোলামেলা এবং সঠিকভাবে ডিজাইন না করা হয়, তবে এর ফলে অশুদ্ধ বা পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি প্রশ্নগুলির মধ্যে প্রাসঙ্গিকতা এবং বৈচিত্র্য না থাকে, তাহলে ফলাফল অগোছালো হতে পারে, এবং বাস্তব তথ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক হ্রাস পায়।
৩. অংশগ্রহণকারীদের মানসিক অবস্থান:
প্রশ্নাবলার ডিজাইনের দ্বারা অংশগ্রহণকারীদের মানসিক অবস্থান প্রভাবিত হতে পারে। একটি ভালো ডিজাইন করা প্রশ্নাবলা, অংশগ্রহণকারীদের পরিপূর্ণভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে উৎসাহিত করতে পারে। আর অপরিষ্কার বা বিভ্রান্তিকর প্রশ্নবলার, তাদের মানসিক অবস্থাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে, এবং তাদের উত্তরের মানও কমে যেতে পারে।
৪. সময় এবং অর্থ সাশ্রয়:
একটি সঠিকভাবে ডিজাইন করা প্রশ্নাবলা জরিপের সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে সাহায্য করে। এটি গবেষকের জন্য সময়মতো ফলাফল সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ নিশ্চিত করে, পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত সংগ্রহ করতে সহায়ক হয়।
উপসংহার:
প্রশ্নাবলার ডিজাইন একটি জরিপ গবেষণার সাফল্য এবং ফলাফলের নির্ভরযোগ্যতার মূল ভিত্তি। সঠিকভাবে ডিজাইন করা প্রশ্নাবলা গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক, অংশগ্রহণকারীদের জন্য সহজ এবং ফলস্বরূপ যথার্থ তথ্য প্রদান করে। তবে, যদি প্রশ্নাবলার নকশায় কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে তা গবেষণার ফলাফলে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। অতএব, গবেষকদের উচিত সঠিক ভাষা, কাঠামো, এবং প্রশ্নের ধরণ নির্বাচন করে প্রশ্নাবলার নকশা করা, যাতে এটি গবেষণার নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করে এবং পর্যাপ্ত এবং সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।