প্রাচীন উত্তরবঙ্গের মানুষদের খাদ্য ও পানীয় সংস্কৃতি :
প্রাচীন উত্তরবঙ্গের মানুষ সাধারণ বাঙ্গালি খাবারই খেত। ভাতই ছিল এখানকার মানুষের প্রধান খাদ্য। এ ছাড়া চিনার ভাত এবং ‘পষরার গুড়া’ (যবের ছাতু) লোকে ভক্ষণ করতেন। ভাতের সঙ্গে ডাল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ, ঘি ইত্যাদি ছিল তাদের খাদ্য। বিবিধ ফলমূলও তারা আহার করত। ভাজা চাউলের ছাতু দরিদ্র লোকেরা অধিক পরিমাণে খেত। প্রাচীন কামরূপে সরিষার তেল এবং মহিষের ঘি-এর সুনাম ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সমাজে। উত্তরবঙ্গে লবণ সহজপ্রাপ্য ছিল না এবং এজন্য দরিদ্র লোকেরা এর পরিবর্তে ‘ক্ষার’ ব্যবহার করত। জলযোগে দই-চিড়ার ব্যবহার অতি প্রাচীন এবং দুগ্ধের অপেক্ষা দই-এর ব্যবহারে লোকে অধিকতর অনুরাগী ছিল। দুগ্ধ ও অন্নপক্ক পায়েস ও উচ্চকোটির লোকেদের এবং সামাজিক ভোজ্যে অন্যতম প্রিয় খাদ্য ছিল। ভোজনের পর পান খাওয়ারও রীতি প্রচলিত ছিল। পূজা-পার্বণেও পান ব্যবহৃত হত এবং অধিবাসী কৌম সমাজের রীতিও তাই ছিল। মাংসের মধ্যে হরিণের মাংস, ছাগ মাংস প্রচলিত ছিল সমাজের সব স্তরেই। বৃহদ্ধর্ম পুরাণের মতে, রোহিত, শাফর, সোল এবং শ্বেতবর্গ ও আঁশযুক্ত অন্যান্য মৎস্য ছিল ব্রাহ্মণদের ভক্ষ্য। উত্তরবঙ্গের লোকেরা সিহলি বা শুকনো মাছ খেত, যা আজও বর্তমান। নানা প্রকার শাক খাওয়ার অভ্যাস তখনকার দিনে প্রচলিত ছিল। ফলের মধ্যে কলা, তাল, আম, কাঁঠাল, নারিকেল ছিল উল্লেখযোগ্য। তেঁতুলের উল্লেখ পাওয়া যায় চর্যাগীতিতে।
পানীয় খাবারের মধ্যে দুধ, নারিকেল জল, ইক্ষুরস, তালরস এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকারের সদ্যজাতীয় পানীয় উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ছিল। বৈশ্য ও শূদ্ররা মদ্যপান করত। গুড় হইতে প্রস্তুত সর্বপ্রকার গৌড়ীয় মদের খ্যাতি ছিল সর্বভারতব্যাপী। ভবদেব ভট্ট তাঁর ‘প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ’ নামক প্রশ্নে নানা প্রকার মদ্যপানীয়ের উল্লেখ করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে দ্বীজদের মধ্যে মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বেলের খোলা করে মদ্যপানের উল্লেখ আছে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থের একটি শ্লোকে। চর্যাগীতিতে দেখা যায় মদ্য ঢালা হত খড়ায় খড়ায়। চর্যাগীতির একাধিক গীতিতে যেভাবে শুন্ডিকালের উল্লেখ পাওয়া যায় তাতে মনে হয় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে মদ্যপান খুব গর্হিত বলে বিবেচিত হত না।