প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিষম ব্যঞ্জনের মিলনে গঠিত যুক্ত ব্যঞ্জনগুলি মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় সমীভূত হয়ে সমব্যঞ্জনে গঠিত যুগ্মব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছিল। যেমন, পর্বত > পব্বত, বা, জন্ম > জন্ম।
প্রাচীন বাংলায় এই যুগ্ম ব্যঞ্জনের মধ্যে একটি লুপ্ত হল। যেমন পব্বত পবত, জন্ম জম। এই লোপের ক্ষতিপূরণস্বরূপ পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ হল। যেমন-
পবত (প্+অ+ ব্+অ+ত্+অ)> পাবত (প্+আব্+অ+ত্+অ)
বা
জম (জ্+অ+ ম্+অ) জাম (জ্+আ+ ম্+অ)
এই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায় অর্ধতৎসম শব্দে। সেখানে সমীভূত যুগ্ম ব্যঞ্জনের একটি লোপ পেয়েছে, কিন্তু পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়নি। যেমন, মিথ্যা > মিছা।
নাসিক্যব্যঞ্জনের সংযোগে গঠিত যুক্তব্যঞ্জনও অনেক সময় সমীভূত হয়নি; তা সত্ত্বেও প্রাচীন বাংলায় এই ধরনের যুক্তব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়েছে। যেমন- বন্ধ > বান্ধ, চন্দ্র > চান্দ।
২) নাসিক্যব্যঞ্জন অনেকক্ষেত্রে লোপ পেল এবং তার ফলে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি অনুনাসিক হয়ে গেল। যেমন, শব্দেন > সাদে।
৩) পাশাপাশি অবস্থিত একাধিক স্বরধ্বনি বজায় ছিল, অর্থাৎ দু’টি মিলে একটি স্বরে পরিণত হয়নি। যেমন, উদাস > উআস। কিন্তু পদের অন্তে অবস্থিত একাধিক স্বর যৌগিক স্বররূপে উচ্চারিত হত এবং ক্রমে দুটি মিলে একক স্বরে পরিণত হল। যেমন-ভণতি ভণই, পুস্তিকা > পোখিআ> পোথী।
৪) পাশাপাশি অবস্থিত দুটি স্বরধ্বনির মাঝখানে প্রায়ই ‘য়’-ধ্বনি শ্রুতিধ্বনি রূপে এসে যেত। যেমন,
নিকটে > নিঅড্ডী > নিয়ড্ডী > নিয়ডি।
৫) স্বরমধ্যবর্তী একক মহাপ্রাণ ধ্বনি প্রায়ই হ-কারে পরিণত হত। যেমন, মহাসুখ মহাসুহ, কথন > কহন।
৬) ‘শ’-এর স্থানে ‘স্’-এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন- এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস (< আশা), সুনুপাখ (শূন্যতা পাখা) ভিড়ি লাহু রে পাস (পাশ)।
৭) চর্যাপদে ‘অ’-ধ্বনির উচ্চারণ ছিল আধুনিক উচ্চারণের তুলনায় সম্ভবত আরও বিবৃত (Open)। সেকারণেই হয়তো চর্যার লিপিবিধিতে শব্দের আদিস্বরে শ্বাসাহত (stressed) স্থানে ‘অ’/’আ’-ধ্বনির বিপর্যয় দেখা যায়। যেমন- অইস/আইস, কবালী/কাবালী, সমাঅ/সামাঅ ইত্যাদি।
৮) ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল- পদমধ্য ‘হ’-ধ্বনির উচ্চারণ সংরক্ষণ (যেমন-‘খণহ’, ‘তহি’ ‘করহু’ ইত্যাদি) এবং মহাপ্রাণ বর্ণ, বিশেষত ‘হ্ম’, ‘হ্ন’, ‘ঢ’-এর অস্তিত্ব (যেমন-‘আহ্মে’, ‘কাহ্নু’, ‘দিঢ়’ ইত্যাদি)। চর্যাপদে সম্ভবত ওড়িয়াসুলভ ‘ল’ ধ্বনি বজায় ছিল। অন্ত্যমিলে তার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন- ‘হেলে’, ‘ডাল’, ‘ডালী’ ইত্যাদি।
৯) চর্যাপদে অপভ্রংশ-অবহঠের মতোই স্বর-সংযোগ দেখা যায়, অর্থাৎ সেখানে স্বরসংকোচ সর্বত্র ঘটেনি। যেমন- ‘অমিঅ’, ‘আইস’, ‘চিঅরাঅ’, ‘করউ’ ইত্যাদি। তবে, স্বরসংকোচের উদাহরণও বিরল নয়। যেমন-‘তৈলোএ’/’তেলোএ’, ‘ইন্দিঅ’/’ইন্দি’, ‘জাইউ’/’জাউ’, ‘করিঅ’/’করি’ ইত্যাদি।
১০) চর্যায় মধ্য বাংলাসুলভ অপিনিহিতির উদাহরণ মেলে না; তবে স্বরসংগতির দু’-একটি উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন, সুসুরা শ্বশুর, ঘিনি ঘেগেলি ইত্যাদি। ১১) নাসিক্যব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে ব্যঞ্জনের সরলীভবন দেখা যায়। পূর্বস্বর দীর্ঘত্বলাভের সঙ্গে সঙ্গে আনুনাসিক হয়ে গেছে- যদিও তা সর্বত্র চিহ্নিত হয়নি। সম্ভবত চর্যাপদে আনুনাসিকতা পুরোপুরি ঘটেনি। নাসিক্যব্যঞ্জন ছিল ক্ষীণ। তাই অনেক সময় পূরক দীর্ঘত্ব ও নাসিক্যব্যঞ্জন পাশাপাশিই অবস্থান করেছে। যেমন- ‘চন্দ’/’চান্দ’, ‘ভন্তি’/’ভাংতি’/’ভান্তী’, ‘তন্তে’/’তান্তি’ ইত্যাদি।