প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদানগুলির গুরুত্ব আলোচনা করো।

অথবা, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাহিত্যিক উপাদানগুলির গুণাগুণ বিচার করো।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদানগুলির গুরুত্ব:

প্রাচীন ভারতবর্ষে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ভারতীয়রা অসাধারণ উন্নতি ঘটালেও প্রকৃত ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো ছাপ ফেলতে পারেননি। তবে প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধিক বা সাহিত্যিক কর্মকান্ডের অভাব ছিল না। তাঁরা আইন, শাস্ত্র, ধর্ম, রাজনীতি, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ লিখেছেন। এর ফলে আধুনিককালের ঐতিহাসিকদের পক্ষে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লেখা কঠিন হলেও অসম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাঁরা সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য নানা উপাদানের সাহায্যে প্রাচীন ভারতের ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা সম্ভব করে তুলেছেন। অতীতের ঘটনা জানার জন্য যে-সমস্ত তথ্যের ওপর ঐতিহাসিকরা নির্ভর করেন, সেই নির্ভরশীল তথ্যগুলিই হল ইতিহাসের মূল উপাদান। এই উপাদানগুলির মধ্যে সাহিত্যিক উপাদান অন্যতম।

সাহিত্যিক উপাদান:

সুপ্রাচীনকাল থেকে আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত যে সমস্ত ভারতীয় গ্রন্থ ও ভারত সম্পর্কিত বিদেশিদের লিখিত গ্রন্থ রচিত হয়েছিল সেগুলি সাহিত্যিক উপাদানের অন্তর্গত। আলোচনার সুবিধার্থে এগুলিকে দু-ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয়। যথা-① দেশীয় সাহিত্য ও বিদেশি সাহিত্য।

দেশীয় সাহিত্য:

বৈদিক সাহিত্য ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব-এই চারটি বেদ এবং সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ এবং সূত্র সাহিত্য নিয়ে বিশাল বৈদিক সাহিত্য গড়ে উঠেছে। ঋগ্বেদ হল বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ। খ্রিস্টপূর্ব 1500 থেকে 900 অব্দের মধ্যে এটি রচিত হয়। ঋগ্বেদ থেকে ‘সপ্তসিন্ধু’ অঞ্চলে আর্যদের বসতি স্থাপন এবং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ ও অন্যান্য প্রয়াত বৈদিক সাহিত্য থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগের (খ্রিস্টপূর্ব 900 থেকে 600 অব্দ) আর্যদের সম্প্রসারণ, আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও তাদের আর্থ-সামাজিক জীবনের নানা বিবরণ পাওয়া যায়।

মহাকাব্য:

রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই মহাকাব্য থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজবংশগুলির কীর্তিকলাপ, আর্য-অনার্য সংঘর্ষ, দাক্ষিণাত্যে আধ সংস্কৃতির প্রসার এবং সেই যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন, বিভিন্ন সামাজিক প্রথা, বর্ণব্যবস্থা, সমাজে নারী ও শূদ্রের অবস্থান প্রভৃতি বিষয়ে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়।

পুরাণ:

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানার জন্য পুরাণগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। পুরাণের সংখ্যা হল 1৪টি। এর মধ্যে বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ অন্যতম। পুরাণগুলি, থেকে বিভিন্ন রাজবংশগুলির উৎপত্তি, বংশতালিকা, প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা, নদনদী, প্রাচীন শহর ও তীর্থস্থানগুলির বিবরণও পাওয়া যায়।

স্মৃতিশাস্ত্র:

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিভিন্ন হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রগুলি, যেমন-মনু স্মৃতি, নারদ স্মৃতি, যাজ্ঞবন্ধ্য স্মৃতি প্রভৃতি মূল্যবান। এগুলি থেকে প্রাচীনকালের রাষ্ট্রীয় কর্তব্য, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে জানা যায়। •

বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য বৌদ্ধ গ্রন্থ, যেমন-ত্রিপিটক, দীপবংশ, মহাবংশ ও জাকতগুলি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পালি ভাষায় রচিত ‘ত্রিপিটক’ অর্থাৎ, বিনয়, সুত্ত ও অভিধম্মপিটকে বৌদ্ধধর্ম ও সংঘ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যাবলি পাওয়া যায়। ‘দীপবংশ’, ‘মহাবংশ’ থেকে বুদ্ধদেব, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সম্রাট অশোক সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা যায়। ‘জাতক’ থেকে গৌতম বুদ্ধের পূর্বজন্মের পরিচয় পাওয়া যায়। জৈন গ্রন্থ, যেমন- ‘ভগবতী সূত্র’, ভদ্রবাহু রচিত ‘জৈন কল্পসূত্র’, হেমচন্দ্র রচিত ‘পরিশিষ্টপার্বণ’ ও রাজশেখর সম্পাদিত ‘প্রবন্ধকোষ’ থেকে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।

সংস্কৃত সাহিত্য আইন, অভিধান, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি গ্রন্থ থেকেও ইতিহাসের মূল্যবান তথ্য মেলে। যেমন-পাণিনির ব্যাকরণ ‘অষ্ট্যাধ্যায়ী’, পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, কামন্দকের ‘নীতিসার’, বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’, কালিদাসের ‘রঘুবংশম্’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ এবং বিশাখদত্তের ‘দেবীচন্দ্রগুপ্তম্’ থেকে গুপ্তযুগের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়।

জীবনচরিত:

প্রাচীন ভারতে রচিত বিভিন্ন জীবনচরিত থেকেও ইতিহাসের তথ্যাদি পাওয়া যায়। বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’, বিলহন রচিত ‘বিক্রমাঙ্কদেব চরিত, সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ প্রভৃতি ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান।

আঞ্চলিক ইতিহাস:

কাশ্মীর, গুজরাট, সিন্ধু, নেপাল প্রভৃতি স্থানের ইতিহাস গ্রন্থ থেকেও অনেক তথ্য পাওয়া যায়। যেমন-কলহন রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত কাশ্মীরের ধারাবাহিক ও প্রামাণিক ইতিহাসের বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।

বিদেশি সাহিত্য:

প্রাচীনকালে বহু বিদেশি, যেমন-গ্রিক, রোমান, চৈনিক, তিব্বতীয় ও মুসলিমরা ভারতে আসেন এবং ভারত সম্পর্কে তাঁদের অভিজ্ঞতা লিপিবন্ধ করেন, যা ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রিক বিবরণ:

গ্রিক ঐতিহাসিক ও ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস-এর রচনা থেকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পারসিক বিজয়ের কথা জানা যায়। গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায় গ্রিক বিবরণ থেকে। তবে গ্রিক লেখকদের মধ্যে ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থের লেখক মেগাস্থিনিস বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচনা থেকে মৌর্য সাম্রাজ্য ও সমকালীন ভারতের বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া পলিবিয়াস রচিত ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ টলেমির রচিত ‘ভূগোল’, প্লিনির রচিত ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’ থেকে ভারত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পাওয়া যায়।

চিনা ও তিব্বতীয় বিবরণ:

ফা হিয়েন রচিত ‘ফো-কুও-কি’, হিউয়েন সাঙ রচিত ‘সি-ইউ. কি’, ইৎ-সিং-এর বিবরণী, তিব্বতীয় পণ্ডিত লামা তারানাথ রচিত ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের জন্ম’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে ভারতে শক, পল্লব, কুষাণ ও গুপ্ত যুগের ইতিহাসের নানা অজানা তথ্য জানা যায়।

আরবীয় বিবরণ:

মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন অলবিরুনি। তিনি সুলতান মামুদের সঙ্গ্যে ভারতে আসেন এবং দীর্ঘকাল ভারতে বসবাস করে ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে অনুশীলন করেন এবং 1030 খ্রিস্টাব্দে ‘কিতাব-উল-হিন্দ’ নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যা থেকে সমকালীন ক্ষয়িত্ব ভারতের সমাজ ধর্মের এক জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদান মূল্যবান হলেও এগুলির নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন-বেদ, মহাকাব্য, পুরাণ, স্মৃতিশাস্ত্র, বৌদ্ধ, জৈনশাস্ত্রগুলি মূলত ধর্মীয় গ্রন্থ। এগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি অতি সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। জীবনচরিতগুলি মূলত বিভিন্ন সভাকবিদের দ্বারা রচিত এবং সেগুলি স্বভাবতই পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। বিদেশি লেখকরা বেশিদিন ভারতে বসবাস করেননি এবং ভারতীয় ভাষা, রীতিনীতিও তাঁদের কাছে অজানা ছিল, ফলে তাঁদের বিবরণীগুলিও যথার্থ ইতিহাস হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রানার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক হন্দের অভাবের কারণে সাহিত্যিক উপাদানগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এগুলি দিয়েই প্রাচীন ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading