বাংলা গদ্যসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।

উনিশ শতকের বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম জীবনে উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু করলেও পরে প্রবন্ধে প্রবেশ করেন। দেশ জাতির জন্য তিনি যেমন প্রবন্ধ লিখেছেন, তেমনি সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে বাংলা সাহিত্যের অশেষ উন্নতি করেছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হাত ধরে বাংলা গদ্যের প্রতিষ্ঠা, বিদ্যাসাগরের হাতে তা পরিণতি লাভ করেছে আর বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যকে শিল্প-সুষমা দান করলেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র একের পর এক প্রবন্ধ লিখে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে অনেকটা এগিয়ে দিয়ে গেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-‘লোকরহস্য’ (১৮৭৪), ‘বিজ্ঞানরহস্য’ (১৮৭৫), ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (১৮৭৫), ‘বিবিধ সমালোচনা’ (১৮৭৬), ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৮৬), ‘পর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৮) ও ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৬৪)। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রয়োজনে তাঁকে একের পর এক প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে। দেশজাতির চেতনাবৃদ্ধিতে যেমন কলম ধরতে হয়েছে, তেমনি পরাধীন বাঙালির ওপর অত্যাচারের চিত্র স্পষ্ট করে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গদর্শন’ প্রসঙ্গে লিখেছেন-“পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম।” তিনি শুধু নিজেই ‘বঙ্গদর্শন’-এ লেখেননি, একদল লেখকগোষ্ঠী তৈরি করে নিয়েছিলেন, যাঁরা বাংলা গদ্যের উন্নতি ঘটিয়েছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম তুলনামূলক সমালোচনার সূত্রপাত করেন। পাশ্চাত্যের চরিত্রের সলো প্রাচ্যের চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা করে এক সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তেমনি প্রাচীন মধ্যযুগের কবিদের তুলনামূলক আলোচনা করে পরস্পরের সম্পর্ক যেমন নির্ণয় করেন, তেমনি দুজনের মিল-অমিল দেখিয়ে দেন। যেমন ‘জয়দেব বিদ্যাপতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন-“জয়দেবের গীত, রাধাকৃত্বের বিলাসপূর্ণ, বিদ্যাপতির গীত, রাধাকৃত্বের প্রণয়পূর্ণ। জয়দেব ভোগ, বিদ্যাপতি আকাঙ্ক্ষা ও স্মৃতি। জয়দেব সুখ, বিদ্যাপতি দুঃখ। জয়দেব বসন্ত, বিদ্যাপতি বর্ষা।” ‘ভারতকলঙ্ক’, ‘বঙ্গদেশের কৃষক’, ‘বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার’, ‘বাঙালির উৎপত্তি’ প্রবন্ধে তিনি দেশ ও জাতির অতীত সন্ধানে অগ্রসর হয়েছেন। হাসিম শেখ, রমা কৈবর্তদের দুর্দশার চিত্র তিনিই প্রথম তুলে ধরেন। বঙ্কিমচন্দ্রের অনবদ্য গ্রন্থ ‘কমলাকান্তের দপ্তর’। আফিমখোর কমলাকান্তের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র দেশ-জাতিসং অনেক দর্শনের কথা শুনিয়েছেন। আফিমখোর কমলাকান্তের মনে হয়েছিল-অপরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন স্থায়ী সুখের উৎস নাই।

‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণকে মানবতার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে তত্ত্বদর্শনে পৌঁছে যান। জগতে সুখ কী, দুঃখ কী, দুঃখ থেকে পরিত্রাণের পন্থা কী, আবার তেমনি অনুশীলন ধর্মের প্রসঙ্গও নিয়ে আসেন। তেমনি বঙ্গদর্শনের পাতায় তিনি সাহিত্য সমালোচনা শুরু করেন। নবীন লেখকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিলেন-“লিখিয়া দেশ জাতির উপকার করিতে পারিলে তবেই লিখিবেন, নচেৎ নয়।” বঙ্কিম বাংলা গদ্যে একটি নির্দিষ্ট রীতি নিয়ে এসেছিলেন, যা ‘বঙ্কিমী রীতি’ নামে প্রচলিত। বাংলা গদ্যের একটি সুদৃঢ় ভিত্তিভূমি তিনি নির্মাণ করে তোলেন। বাংলা গদ্যের যে মৃদুতা, স্পষ্টতা, তীক্ষ্ণতা, যুক্তিবোধ ও গতি, তাঁর কাছেই আমরা তা পেয়েছিলাম-“প্রসঙ্গের প্রতি আমার যেরূপ, তাহার মঙ্গলা গাইয়ের প্রতিও তদ্রুপ। একজন ক্ষীর সর নবনীতের আকর, দ্বিতীয় তাহার দানকর্ত্রী।”

বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় যেমন যুক্তিবোধ প্রয়োগ করেছেন, তেমনি হাস্যরসের জোগান দিয়েছেন ‘লোকরহস্য’ গ্রন্থে। কোথাও ব্যঙ্গবাণে আঘাত করে প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটন করেছেন। কৃষ্ণচরিত্রের অলৌকিকতা বাদ দিয়ে প্রকৃত রহস্য সন্ধানে তিনি যেমন অগ্রসর হন, তেমনি বাঙালি জাতির মিলনবাণী রচনা করেন। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-“একদিন আমাদের বঙ্গভাষা কেবল একতারা যন্ত্রের মতো এক তারে বাঁধা ছিল, কেবল সহজ সুরে ধর্ম সংকীর্তন করিবার উপযোগী ছিল; বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে এক-একটি তার চড়াইয়া আজ তাহাকে বীণাযন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন |

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading