বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্যাপতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় কেন? সেই বিষয়ে তোমার মতামত দাও।

বিদ্যাপতিকে বাংলা সাহিত্যে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে কেন
মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর শেষার্ধে মিথিলার দ্বারভাঙ্গা জেলার মধুবনী মহকুমায় বিসফি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বেশ কয়েকজন রাজার রাজত্বকালে মিথিলার রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন বিদ্যাপতি। ইনি ছিলেন অ-বাঙালি আবার বাঙলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীও রচনা করেননি। তাঁর রাধা-কৃষ্ণবিষয়ক পদগুলি প্রাচীন মৈথিলিতে রচিত। মৈথিলি কোকিল’ বিদ্যাপতির পদাবলী বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী মিথিলা অপেক্ষা বাংলাদেশে অধিক সমাদৃত হয়েছে। বিদ্যাপতির রচিত পদগুলি চৈতন্যদেব থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পরমতৃপ্তির সঙ্গে আস্বাদন করতেন। বিদ্যাপতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাঙালি কবি গোবিন্দদাস নিজেই ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি‘ উপাধি লাভ করেছিলেন। বাঙালির রস চৈতন্যে বিদ্যাপতির শাশ্বত প্রতিষ্ঠাই হয়তো তাঁকে বিশুদ্ধ বাঙালি কবি আসনে স্থানলাভ ঘটিয়েছে।
মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি মিথিলার কবি হওয়া সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করার কারণগুলি হল:-
(ক) সে যুগে মিথিলা ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আদান প্রদান অর্থাৎ বাংলা থেকে বহু ছাত্র ন্যায়, মীমাংসা ও সংস্কৃত শিক্ষা করতে মিথিলায় যেত। সে সময় বাঙালী ছাত্ররা মিথিলা থেকে বিদ্যাপতির পদকে মুখে মুখে বহন করে নিয়ে আসতো, এইভাবে বিদ্যাপতির বাংলা চর্চা বাংলা সাহিত্যে অর্ন্তভুক্তির উল্লেখযোগ্য কারণ হয়ে ওঠে।


(খ) খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতাব্দীতে রঘুনাথ শিরোমণি এবং আরো বেশ কয়েকজন বাঙালি পন্ডিত মিথিলায় যেতেন এবং সেখান থেকে তাঁরা ন্যায় গ্রন্থ মুখস্থ করে নিয়ে এসে নবদ্বীপে ন্যায় শাস্ত্রকে নতুন ব্যাখ্যায় পরিবেশন করতে শুরু করলেন। ফলে মিথিলার ছাত্ররা নবদ্বীপে আসতে শুরু করলেন শাস্ত্র অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্যে। এইভাবে ধীরে ধীরে মিথিলার সঙ্গে বাংলার সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের যোগসূত্র আরোও সুদৃঢ় হতে লাগল। মিথিলা থেকে বিদ্যাপতির পদ দ্রুতগতিতে নানা পন্ডিত ও ছাত্রদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো। বিদ্যাপতির জীবদ্দশাতেই তাঁর সমস্ত পদাবলী বাংলায় প্রচারিত হয়েছিল।


(গ) বাংলা-ভাষার যে ‘পূর্বমাগধী’ থেকে, সেই পূর্বমাগধী থেকেই আবার সৃষ্টি হয়েছে ‘মৈথিলি ভাষা। যা মিথিলার কবি বিদ্যাপতির কাব্যভাষা। যেহেতু বাংলা ও মৈথিলি’ উভয়ভাষার মূলে ‘পূর্বমাদী’। সেই সূত্রে পূর্বভাষার আত্মীয়তা বন্ধন সূত্রে মৈথিলী ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার একটা স্বাভাবিক যোগ থেকে যায়।


(ঘ) বিদ্যাপতি মৈথিলি হলেও তাঁকে বৈষ্ণব পদ সাহিত্যে থেকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই। তিনি বাঙালি না হলেও তাঁর রাধা-কৃষ্ণলীলা বিষয়ক পদের সঙ্গে বাঙালির চারশ বছরের বেশী সম্পর্ক। অনেক সুখদুঃখ আনন্দবেদনার সঙ্গী বিদ্যাপতির রাধা-কৃষ্ণবিষয়ক পদাবলী আজ বাংলার প্রাণের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। বাঙালির ভাব ও ভৌম জীবনের মানস পরিবর্তনে যে মহামানবের অবদান সর্বাধিক সেই শ্রীচৈতন্যদেব ও নিয়মিত বিদ্যাপতির পদের রসাস্বাদন করতেন। এ সম্পর্কে চৈতন্যচরিত গ্রন্থে পাওয়া গেছে—
“জয়দেব চন্ডীদাস বিদ্যাপতির গীত আস্বাদনে রামানন্দ স্বরূপ সহিত।’


(ঙ) বিদ্যাপতির মৈথিলি গানের প্রবেশ ঘটল বাংলাদেশে, পরে বাঙালি কীর্তনীয়া ও পাঠকদের প্রভাবে মৈথিলী, বাংলা ও অবহট্‌ঠ ওই তিন ভাষায় বিশ্রণে কৃত্রিম কাব্য ভাষা ব্রজবুলির জন্ম হল। কবি ঈশ্বরগুপ্ত তাঁর সম্পাদিত দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’ এ প্রথম ‘ব্রজবুলি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এই মিশ্রভাষা মৈথিলির চেয়েও ও শ্রুতিসুখকর। বাংলাদেশে এই মিশ্র ও কৃত্রিম ভাষা ব্রজবুলিতে অধিকাংশ বৈষ্ণবপদ রচিত হয়েছে। এর আদর্শে বাংলায় প্রচলিত বিদ্যাপতির ভাষাতেও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এই ব্রজবুলি পরবর্তী যুগে, এমনকি আধুনিক যুগেও বাংলার কবি সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। রবীন্দ্রনাথের ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ ব্রজবুলির ঢঙেই রচিত। সুতরাং বাংলা বৈষ্ণব গীতি থেকে ব্রজবুলির ভাষাকে বাদ দিলে বৈষ্ণব গীতি কবিতার মাহাত্ম থাকেনা।


(চ) বাঙালি কীর্তনীয়ারা যদি বিদ্যাপতির পদ মুখস্থ না করতেন বাঙালিরা যদি পদগুলো সংগ্রহ করে না রাখতো তাহলে বিদ্যাপতির পদগুলো কালের অতলগর্ভে কবেই হারিয়ে যেতো। গ্রীয়ান সাহেব মাত্র বিরাশিটি বিদ্যাপতির পদ আবিষ্কার করেছিলেন, অথচ ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার বিদ্যাপতির আটশ’রও বেশী পদের সন্ধান দিয়ে গেছেন। বিদ্যাপতি মিথিলার কবি নিঃসন্দেহে কিন্তু তাঁর উপর বাঙালির ভালোবাসার দাবী সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে।


(ছ) বিদ্যাপতি আপন কাব্যখ্যাতির প্রভাবে সমগ্র পূর্বভারতে হয়ে উঠেছিলেন ‘কবি সার্বভৌম’। আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন—‘বাঙালি বিদ্যাপতির পাগড়ী খুলিয়া লইয়া ধুতি চাদর পরাইয়া দিয়াছে।’
(জ) মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি বাংলাভাষায় পদরচনা করেনি, লিখেছিলেন মাতৃভাষা মৈথিলিতে। তবুও তাঁর পদের দ্বারা মিথিলার লোকেরা যত না অনুপ্রাণিত হয়েছে তদাপেক্ষা বেশী প্রভাবিত হয়েছেন বাঙালিরা। বৈষ্ণবপদ সাহিত্যে বিদ্যাপতির অসাধারণ প্রভাবই তাঁর স্বরূপ বোঝা যায়। ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার, গীতধর্মীতায় তাঁর পদ পূর্বভারতে শীর্ষ স্থানাধিকারী। তাঁর মতো প্রথম শ্রেণীর গীতি কবির প্রতিভা মধ্যযুগের পূর্বে পূর্বভারতে বড় একটা দেখা যায় না। বাংলা বৈষ্ণবগীতি কবিতা থেকে বিদ্যাপতির পদকে বাদ দিলে বাংলা গীতিকবিতা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। বাংলার দুই বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতির পথ অনুসরণ করে চলেছেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ ভাব শিষ্য গোবিন্দদাস কবিরাজ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading