“বিদ্যাপতি ও জয়দেব” প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক দুই বিখ্যাত কবি বিদ্যাপতি ও জয়দেবের তুল্যমূল্য বিচার অত্যন্ত বিশদ ও স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে করেছেন। এখানে তিনি তাঁদের কাব্যপ্রকৃতি, ভাষাশৈলী, ভাবগত ও সৃষ্টিগত পার্থক্য, এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক দুই কবির জীবন, তাঁদের সাহিত্যিক প্রভাব এবং কাব্যের প্রকৃতি তুলে ধরে তাঁদের পৃথক বৈশিষ্ট্য ও অবদানকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দুই কবিকে পাশাপাশি রেখে কাব্যিক রস, প্রেম, ভক্তি, এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সামঞ্জস্য এবং পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রাবন্ধিক প্রথমে জয়দেবের কাব্যের মূল বিষয়বস্তু ও শৈলীর পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি জয়দেবের “গীতগোবিন্দ” কাব্যের ভক্তিমূলক ও প্রেমপূর্ণ ভাবনার উপস্থাপন করে তাঁর কাব্যের গভীরতা এবং রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে কেন্দ্র করে আধ্যাত্মিক প্রেমের উপস্থাপন ব্যাখ্যা করেন। জয়দেবের কাব্যে ভক্তির সঙ্গে রোমান্টিক প্রেমের সমন্বয় লক্ষ করা যায়, যা ভক্তি সাহিত্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই গীতগোবিন্দে প্রেমিক-প্রেমিকা রূপে কৃষ্ণ ও রাধার চরিত্রায়ণ করেন এবং তাঁদের মিলন ও বিরহের বিবরণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক প্রেমের এক গভীর রূপ দেন।
এদিকে, বিদ্যাপতির কাব্যরসের ভিন্ন এক স্বাদ রয়েছে, যা মৈথিলী ভাষায় রচিত এবং অধিক ব্যক্তিগত ও অভিজাত প্রেমের অনুভূতি প্রকাশ করে। বিদ্যাপতির পদাবলীতে নায়িকা (রাধা) কৃষ্ণের প্রেমে আবিষ্ট হয়ে থাকেন এবং তাঁর চিত্তে এক ধরনের অতৃপ্তি বা বিরহের সুর বিদ্যমান। বিদ্যাপতির প্রেম গভীর এবং অধিক ব্যক্তিগত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, যা এক প্রকার অভিজাত কাব্যিক শৈলীতে পরিবেশন করা হয়। বিদ্যাপতি তাঁর কাব্যে নারী-পুরুষের প্রেমকে অনেক বেশি মানবিক ও বাস্তবিক রূপে প্রকাশ করেছেন, যেখানে ভক্তি ভাবের পাশাপাশি রোমান্টিক প্রেমের উপস্থাপনও চোখে পড়ে।
প্রাবন্ধিক বিদ্যাপতি ও জয়দেবের তুলনায় লক্ষ্য করেন যে, জয়দেবের কাব্যে কৃষ্ণের প্রেম মূলত ভক্তির সুরে গাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, বিদ্যাপতির কাব্যরসে রোমান্টিকতার ছোঁয়া প্রবল এবং তাঁর রচনা ব্যক্তিগত ও প্রাকৃতিক মানবিক প্রেমের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। জয়দেবের কাব্যের পটভূমিতে ধর্মীয় ভাবের প্রাধান্য দেখা গেলেও বিদ্যাপতির পদাবলীতে মানুষের সহজাত প্রেমের প্রকাশ বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।