ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শিক্ষা বিরোধী আন্দোলনের সূচনা কি কি কারণে হয়েছিল? ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব লিখুন।

ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শিক্ষা বিরোধী আন্দোলনের সূচনা-

উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ ঔপনিবেশিত শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। যাকে বলা হয় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন।

ভারতবর্ষে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। এই সময় ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার ঘটায় সভ্যতা ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছিল। সমাজজীবনে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার প্রসার ঘটায় রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ নেতা এদেশের সমাজজীবন থেকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, সংকীর্ণতা প্রভৃতি দূর করে প্রাচীন ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে এদেশে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার প্রচেষ্টা শুর করেছিলেন। 1854 খ্রিস্টাব্দে উড-এর ডেসপ্যাচে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হল-সরকারি শিক্ষার লক্ষ্য হবে শাসনকার্য পরিচালনা ও ব্যাবসাবাণিজ্যের কাজে সহায়তা করার জন্য বিশ্বাসযোগ্য সরকারি কর্মচারী তৈরি করা। সরকারি এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী শিক্ষিত মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতবর্ষে। বিভিন্ন অঞ্চলে সার্বিক শিক্ষা রূপায়ণ, নারীশিক্ষার বিস্তার ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের সপক্ষে যে আন্দোলন দানা বেঁধেছিল তার মধ্যে ভবিষ্যৎ শিক্ষা আন্দোলনের বীজ নিহিত ছিল। উড-এর ডেসপ্যাচে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় নিরপেক্ষ নীতি এবং গণশিক্ষার বিষয়টিকে আংশিক স্বীকৃতি দিলেও জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। এর প্রতিবাদে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়চন্দ্রে দত্ত প্রমুখ নেতাগণ সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান এবং জনশিক্ষার সার্বিক রূপায়ণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। জাতীয় চেতনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংরেজ সরকার শিক্ষাসংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। 1885 খ্রিস্টাব্দে স্যার উমেশচন্দ্রে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর জাতীয় নেতৃবৃন্দ ইংরেজ সরকার প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেন। পরবর্তীকালে জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় বেসরকারি উদ্যোগে দেশীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে মাতৃভাষা চর্চা ও জাতীয় ইতিহাস পঠনপাঠনের মধ্য দিয়ে দেশাত্মবোধক পরিবেশ তৈরি করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 1901 খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বোলপুরে আশ্রম স্থাপন ও 1902 খ্রিস্টাব্দে সতীশচন্দ্রে মুখোপাধ্যায়ের ‘ডন সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশীয় শিক্ষার প্রতি গভীর আস্থার মনোভাব গড়ে ওঠে।

1904 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন যে শিক্ষানীতি ঘোষণা করলেন তার মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশীয় নেতৃবৃন্দের শিক্ষাসংস্কার বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হল। এর প্রতিবাদে জনমত সংগঠিত করার জন্য সেই সময় জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদী আন্দোলনের ডাক দেন। 1906 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষাপরিষদ গঠন করা হয় এবং এই পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত রূপায়ণ করার জন্য কার্যকরী সমিতি গঠন করা হয়।

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে জাতীয় উন্নতিসাধনের উদ্দেশ্যে দেশীয় আদর্শে শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য 1906 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষাপরিষদের নেতৃত্বে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ স্থাপিত হয়। অরবিন্দ ঘোষ এই কলেজের অধ্যক্ষ এবং ডন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রধান কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ওই সময় বাংলাদেশ নামে পৃথক কোনো দেশ ছিল না। ১০টি জাতীয় উচ্চবিদ্যালয় এবং যাদবপুরে কারিগরি ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়েছিল।

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই সময়কালে অর্থাৎ 1920-1922 খ্রিস্টাব্দ অবধি জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় হিসাবে ধরা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সারা দেশে 1349টি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোলপুরের আশ্রমট রূপান্তরিত হয়ে বিশ্বভারতী বিদ্যালয় রূপে পরিচিতি লাভ করে। দেশের সর্বত্র মেডিকেল কলেজ, আট ও টেকনিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা দ্বিতীয় পর্যায়েই হয়েছিল।

আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ 1930-1938 খ্রিস্টাব্দ অবধি সময়কালে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের। হাতে শিক্ষার অর্পণ করা হয়েছিল।

1938-1939 বেসরকারি উদ্যোগে স্বাধীন ভারতে শিক্ষা পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। 1945 খ্রিস্টাব্দে ওয়াধায় একটি পূর্ণাঙ্গ বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল। এইভাবে লক্ষ করা যায়, জাতীয় শিক্ষা-আন্দোলনের চরম পরিণতি অবস্থায় 1947 খ্রিস্টাব্দ্দে দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব-

ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় ইতিবাচক, নেতিবাচক এবং ঔপনিবেশিক বিরোধিতার সূচনা।

(ক) ইতিবাচক প্রভাব:

(1) প্রাথমিক থেকে উচ্চতম । স্তর পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের শিক্ষায় প্রবেশাধিকার।

(2) নারীশিক্ষা, শিক্ষক-শিক্ষণ, বৃত্তি এবং কারিগরি শিক্ষা।

(3) মেধা-বৃত্তি।

(4) সুগঠিত শিক্ষা বিভাগ এবং পরিবর্তন ব্যবস্থা।

(5) জনসাধারণের মধ্যে একটি অংশকে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করা।

(6) শিক্ষায় পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করা এবং তাদের কোনো কোনো ইতিবাচক সুপারিশকে কার্যকরী করা ইত্যাদি।

(খ) নেতিবাচক প্রভাব:

(1)স্থানীয় জনসাধারণের চাহিদা সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক করা হয়নি। নিরক্ষরতা দূরীকরণে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

(2) ভারতবর্ষের সম্পদ ভারতীয় জনগণের শিক্ষাসহ অন্যান্য উন্নয়নের কাজে ব্যয় না করে নিজেদের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিতে ব্যয় করা।

(3) চাহিদা অনুযায়ী বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়নি।

(4) শিক্ষার প্রসারে টুইয়ে পড়া নীতি প্রয়োগ।

(5) ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি রক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়নি।

(6) প্রাথমিক শিক্ষাকে দুর্বল রেখে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার প্রতি গুরুত্বদান।

(7) শিক্ষার মাধ্যমে আর্থিক বৈষম্য দূর করার কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি ইত্যাদি।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading