ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা লেখ।

ভারতের সর্ববধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকার:


ভারতীয় সংবিধানে ১৪-১৮ নং ধারায় সাম্যের অধিকার ঘােষিত ও স্বীকৃত হয়েছে।

[1] আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠা: সংবিধানের ১৪ নং ধারায় দুটি অধিকারের উল্লেখ রয়েছে一

• আইনের দৃষ্টিতে সমতা: আইনের দৃষ্টিতে সমতার অর্থ হল সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও অবস্থা নির্বিশেষে কোনাে ব্যক্তি দেশের আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু ভারতীয় সংবিধানে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা নীতির কয়েকটি উল্লেখযােগ্য ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন—

o সাধারণ নাগরিকের তুলনায় পুলিশ কর্মচারীরা ব্যাপক ক্ষমতা ভােগ করে থাকেন এবং
o সংবিধানের ৩৬ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যায় না।

আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার:

আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারের মাধ্যমে সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আইন সমভাবে প্রযুক্ত হবে। এই অধিকারের অর্থ হল লােকের অবস্থা বা প্রকৃতির বিভিন্নতা বিচার করে প্রত্যেক আইনকে সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়ােগ করতে হবে। অবশ্য রাষ্ট্র যুক্তিযুক্তভাবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে শ্রেণিবিভক্ত করতে পারে এবং পৃথক পৃথক শ্রেণির জন্য রাষ্ট্র পৃথক আইন প্রণয়ন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রত্যেকে সমানভাবে কর দেবে এরূপ নয়। আয়কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগণকে আয়ের পরিমাণ অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে বিভিন্ন হারে আয়কর ধার্য করা হয়।

বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধকরণ:

সংবিধানের ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে যে ধর্ম-জাতিবর্গস্ত্রী-পুরুষ এবং জন্মস্থানজনিত কারণে কোনাে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। এ ছাড়া কোনাে নাগরিককে উপরোক্ত যে-কোনাে কারণের জন্য দোকান, সাধারণের ব্যবহার্য রেস্তোরাঁ, হােটেল ও প্রমােদস্থলে প্রবেশ এবং রাষ্ট্র কর্তৃক পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে তৈরি করা কূপ, জলাশয়, স্নানের ঘাট, রাস্তা ও আশ্রয়স্থল ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। তবে রাষ্ট্র নারী, শিশু ও সামাজিক বা শিক্ষাগত দিক থেকে অনগ্রসর শ্রেণিসমূহ, তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন, করতে পারে।

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমানাধিকার:

১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, স্ত্রী, পুরুষ, বংশধারা, বর্ণ, জন্মস্থান বা বাসস্থানের ভিত্তিতে কোনাে নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা চলবে না। নিয়ােগ ছাড়াও বেতন, পদোন্নতি, ছুটি, পেনশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হবে। অবশ্য এই অধিকারের কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন一

• রাষ্ট্র প্রয়ােজন মনে করলে কোনাে বিশেষ অনুন্নত শ্রেণির জন্য সরকারি চাকরি সংরক্ষণ করতে পারে। সরকারি চাকরিতে তপশিলি জাতি, উপজাতি এবং অনগ্রসর (OBC) শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়।

• ধর্ম বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত চাকরি সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

• সংসদ আইন করে কোনাে রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সরকারি চাকরিতে নিয়ােগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসগত যােগ্যতাকে আবশ্যিক শর্ত হিসেবে আরােপ করতে পারে।

অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকরণ:

১৭ নং ধারায় অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংসদে ১৯৫৫ সালে অস্পৃশ্যতাবিরােধী আইন পাস করা হয়। এর দ্বারা অস্পৃশ্যতা আচরণকারীদের শাস্তির বিধান লিপিবদ্ধ হয়েছে।

[5] উপাধি নিষিদ্ধকরণ: সংবিধানে ১৮ নং ধারায় নাগরিকদের মধ্যে গণতন্ত্রসুলভ সাম্য প্রতিষ্ঠাকল্পে বলা হয়েছে যে, কোনাে ভারতীয় নাগরিক দেশি বা বিদেশি পদবি বা উপাধি গ্রহণ করতে পারবে না, কিন্তু সামরিক বা শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক উপাধির ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযােজ্য হবে না।

ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত স্বাধীনতার অধিকার:

ভারতীয় সংবিধানের ১৯-২২নং ধারায় স্বাধীনতার অধিকার ঘােষণা করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে ১৯ নং ধারায় ছয় দফা স্বাধীনতার অধিকার ঘােষিত হয়েছে। সেগুলি হল一

[1] বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার [১৯(১) (ক)নং ধারা]: বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার অনুসারে নাগরিকরা নিজস্ব বিবেক, বুদ্ধি, মতাদর্শ ও ধ্যানধারণা অনুযায়ী লিখিত বা মৌখিকভাবে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারে। তবে一
• (i) ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি রক্ষা,
• (ii) রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষা,
• (iii) বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা,
• (iv) দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা,
• (v) শ্লীলতা বা নৈতিকতা সংরক্ষণ,
• (vi) আদালত অবমাননা প্রতিরােধ করা,
• (vii) মানহানি প্রতিরােধ করা,
• (viii) অপরাধমূলক কাজে প্ররােচনা দেওয়া বন্ধ করা ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্র বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরােপ করতে পারে।

[2] সমবেত হওয়ার অধিকার [১৯(১) (খ) নং ধারা]: ভারতীয় নাগরিকদের সমবেত হওয়ার অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। অবশ্য সমবেত হওয়ার অধিকারের ওপর কিছু যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরােপিত। হয়েছে। সেগুলি হল—
• (i) সভাসমাবেশ শান্তিপূর্ণ হবে,
• (ii) নিরস্ত্রভাবে সমবেত হতে হবে,
• (iii) জনশৃঙ্খলা এবং সার্বভৌমিকতা ও সংহতির স্বার্থে রাষ্ট্র যে-কোনাে সমাবেশের ওপর যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরােপ করতে পারে।

[3] সংঘ বা সমিতি গঠনের অধিকার [১৯(১) (গ)নং ধারা]: ভারতের নাগরিকরা যে-কোনাে সংঘ বা সমিতি স্বাধীনভাবে গঠন করতে পারে| সাহিত্যসংস্কৃতি, বিজ্ঞান, খেলাধুলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংঘ বা সমিতি গঠন করা ছাড়াও রাজনৈতিক দল এবং শ্রমিক সংঘ গঠন এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এই অধিকারের ওপর বাধানিষেধ আরােপ করে সংবিধানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবিঘ্নকারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এবং নীতি-বিগর্হিত উদ্দেশ্যে গঠিত সংঘ বা সমিতির ওপর রাষ্ট্র যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ আরােপ করতে পারে। এ ছাড়া ভারতের সার্বভৌমিকতা ও সংহতির স্বার্থেও এই অধিকারটি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।

[4] চলাফেরার ও বসবাসের অধিকার [১৯(১) (च) ও (ও) নং ধারা]: ভারতের সর্বত্র স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার [১৯(১) (ঘ) নং ধারা) এবং ভারতীয় ভূখণ্ডের যে-কোনাে অঞ্চলে বসবাস করার অধিকার ভারতীয় নাগরিকদের [১৯(১)(৬) নং ধারায়] অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকাররূপে স্বীকৃত। তবে জনস্বার্থে এবং তপশিলি উপজাতিদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র এই দুটি অধিকারের ওপর যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরােপ করতে পারে।

[5] বৃত্তি, পেশাগ্রহণ বা ব্যাবসাবাণিজ্যের অধিকার [১৯(১) (ছ)নং ধারা]: যে-কোনাে বৃত্তি, পেশাগ্রহণ বা ব্যাবসাবাণিজ্যের অধিকার প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এই অধিকারটিও কিছু বাধানিষেধের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যেমন, জনস্বার্থ রক্ষায় প্রয়ােজন। হলে রাষ্ট্র উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ আরােপ করতে পারে। বিভিন্ন বৃত্তি বা পেশার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রয়ােজনীয় যােগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে পারে ইত্যাদি।

সংবিধানে ২০, ২১ এবং ২২নং ধারায় নাগরিকদের জন্য স্বাধীনতার অধিকারের অন্য ব্যবস্থাগুলি উল্লিখিত হয়েছে।

২০ নং ধারা: ২০(১)নং ধারায় বলা হয়েছে যে, দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করার অপরাধ ছাড়া কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। একই অপরাধের জন্য কোনাে ব্যক্তিকে একাধিকবার অভিযুক্ত ও দণ্ডিত করা যাবে না [২০(২)নং ধারা]। কোনা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে তার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না [২০(৩) নং ধারা]।

২১ নং ধারা: ২১নং ধারায় বলা হয়েছে আইন-নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়া কোনাে ব্যক্তিকে তার জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এ ছাড়া ২০০২ সালে ৮৬তম সংবিধান সংশােধনী অনুযায়ী ২১(ক) নামে নতুন একটি ধারা সংযােজিত করে শিক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দান করা হয়েছে। এই ধারায় ঘােষণা করা হয়েছে রাষ্ট্র ৬-১৪ বছর বয়সি বালকবালিকাদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করবে।

২২ নং ধারা: সংবিধানের ২২নং ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনাে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে। আটক ব্যক্তিকে তার আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দিতে হবে| এ ছাড়া গ্রেফতার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করতে হবে। তবে ‘শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি’ এবং ‘নিবর্তনমূলক আটক আইনে’ ধৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে উল্লিখিত নিয়মগুলি কার্যকর হবে না।

স্বাধীনতার অধিকারের সীমাবদ্ধতা

বস্তুতপক্ষে, পৃথিবীর কোনাে রাষ্ট্রই তার নাগরিকদের অবাধ স্বাধীনতার অধিকার দিতে পারে না। ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষা, জনস্বার্থ ও জনশৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ১৯ নং ধারায় বর্ণিত স্বাধীনতার অধিকারগুলির ওপর যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরােপিত হয়েছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading