রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটোগল্পে একদিকে যেমন সমাজ ও প্রকৃতির রূপকে তুলে ধরেছেন তেমনি অন্যদিকে সমকালীন রাজনৈতিক ভাবনাকেও অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। আমাদের আলোচ্য ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনা রূপায়িত হয়েছে। ইংরেজ শাসনে এদেশীয় মানুষের দুরবস্থা ও অসহায়তা এই গল্পে সমানভাবে চিত্রিত। ইংরেজ শাসনের দৌর্দন্ড প্রতাপ, স্বদেশীয় মানুষদের মানুষ জ্ঞান না করা, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একশ্রেণীর দেশীয় মানুষের ইংরেজ তোষামোদের ফলে দেশের সাধারণ মানুষদের যে দুঃসহ অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল গল্পটি সেই প্রেক্ষাপটে লিখিত। ফলে গল্পটিতে একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথের সমাজ সচেতনতা ফুটে উঠেছে তেমনি অন্যদিকে প্রকাশ পেয়েছে রাজনৈতিক সচেতনতা।
‘গোরা’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই সেখানে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক ইংরেজ বর্বরতাকে রবীন্দ্রনাথ ধিক্কার জানিয়েছেন- যার সূচনা আমরা দেখেছি ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে। ভারতবর্ষীয় ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার এবং চাটুকার বৃত্তিসম্পন্ন কিছু দেশীয় বাঙালির অভব্য আচরণ এ গল্পে রূপায়িত। নায়ক শশীভূষণের জীবনের তিনটি ঘটনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাবনাকে রূপ দিয়েছেন।
গল্পের নায়ক শশীভূষণের সঙ্গে গিরিবালার সম্পর্ক প্রথম গড়ে ওঠে লেখাপড়া চর্চার মধ্য দিয়ে। গিরিবালাই তার একমাত্র সমঝদার বন্ধু। গিরিবালা তার কাছে বর্ণমালা শিখেছে, বইও পড়েছে দু-চারখানা। আর গিরিবালার সাহচর্যেই শশীর পল্লীবাস অনেকটা সহনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু গিরিবালার বাবা হরকুমারের সঙ্গে শশীর সম্পর্ক সহজ ছিল না অথচ জয়েন সাহেবের কুকুরের জন্য ঘি জোগান দিতে না পারায় হরকুমারকে অপমানিত হতে হয়। এই অপমানের প্রতিবাদ করার জন্য এগিয়ে এসে শশীভূষণ মোকদ্দমা করেন। কিন্তু একসময় শশীকে না জানিয়ে হরকুমার এ মোকদ্দমা তুলে নেয়।
শশীভূষণ নদীপথে কলকাতা যাওয়ার সময় তার জীবনে দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটল একটি পালতোলা পাট বোঝাই দ্রুতগামী মহাজনী নৌকা সাহেব ম্যানেজার বন্দুকের গুলিতে ফুটো করে দেয়। শশীভূষণ নৌকার মাঝি-মাল্লাদের উদ্ধার করেন এবং শেষপর্যন্ত কলকাতায় না গিয়ে গ্রামে ফিরে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। তা সত্ত্বেও সাহেব বেকসুর খালাস পায়। এই পরাজয়ের গ্লানি শশীভূষণকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে।
পুনরায় কলকাতায় রওনা হবার সময় শশীভূষণের জীবনে তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বোট জেলেদের জালে জড়িয়ে গেলে অঘটন ঘটে। জাল এবং জেলে দুই- ই যথাসম্ভব নত হলেও সে জাল টুকরো টুকরো করা হল এবং ধরে নিয়ে যাওয়া হল চারজন নিরপরাধ জেলেকে। শশী এখানেও প্রতিবাদীর ভূমিকা নেয়, প্রথমে মৌখিক প্রতিবাদ করে, পরে পুলিশের বড়োকর্তার হিন্দিভাষায় অসম্মানসূচক কথা শুনে সাহেবকে শশীভূষণের প্রহার “বালকের মতো, পাগলের মতো মারিতে লাগিলেন ফলে শশীভূষণের কারাদণ্ড হল। সে বাবাকে আপিল করতে দিল না। কারণ ‘জেল ভাল’! লোহার বেড়ি মিথ্যা কথা বলে না কিন্তু জেলের বাইরে যে স্বাধীনতা আছে সে আমাদিগকে প্রতারণা করিয়া বিপদে ফেলে।”
শশীভূষণের জীবনে এই তিনটি ঘটনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সমকালীন ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের নির্মম অত্যাচারকে তুলে ধরেছেন। সেইসময় লেখা ‘অপমানের প্রতিকার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই মানসিকতার প্রকাশ লক্ষ করা যায় সেখানে বাঙালি মোসাহেব বৃত্তিকে নিন্দার চোখে দেখা হয়েছে। ইংরেজদের অত্যাচার থেকেও স্বজাতির প্রতি বাঙালির ব্যবহার সেসময় কেমন ছিল প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ তা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যার প্রকাশ ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে লক্ষ করা যায়। খুলনার জেলাশাসক বেল সাহেবের ঘটনা এবং পাবনার একজন ব্রাহ্মণ কর্মচারীর উপর পুলিশের লাঞ্ছনা এই গল্পের বাস্তব প্রেক্ষাপট রচনা করেছে।
গোরার মতো বলিষ্ঠ প্রচণ্ড পৌরুষ তার না থাকলেও শশীভূষণ তার মতোই ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে জেলে গেছেন। জমিদাররূপে রবীন্দ্রনাথ তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ব্রিটিশ শাসিত পল্লীবাংলার অত্যাচারী জমিদার, নায়েব, ম্যাজিস্ট্রেট প্রমুখের কথা জানতেন। এ গল্পে আমরা দেখতে পাই গিরিবালার বাবা বলেই নয় অত্যাচারিত, পীড়িত একজন বাঙালির পক্ষ থেকেই শশী হরকুমারের হয়ে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত হরকুমার গোপনে এ মামলা তুলে নেন। আবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘটনাটিতে নিরপরাধ মাঝিদের উপর সাহেবদের নির্মম অত্যাচার এবং তার ফলে শশীভূষণের প্রতিক্রিয়া, মাঝিদের পক্ষ অবলম্বন করে সাহেবদের বিরুদ্ধে মামলার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সচেতনতাই প্রকাশ পেয়েছে এবার তৃতীয় ঘটনাতে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সাহেবকে শশীভূষণের চপেটাঘাত এবং তার ফলে তার হাজতবাস ও শারীরিক নিগ্রহ সমকালীন রাজনীতিকেই চিনিয়ে দেয়। এককথায় রবীন্দ্রনাথ এইসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশদের অকারণ অত্যাচার, ন্যায়বিচারের নামে প্রহসন এবং দেশীয় মানুষদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করেছেন।
উপরি-উক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি ভাবনাকে কয়েকটি ঘটনা অবলম্বনে রূপ দিয়েছেন। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতে স্বৈরাচারী মানসিকতা, বিচারের নামে প্রহসন এবং স্বজাতীয়দের প্রতি বাঙালির ব্যবহার ব্যাঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরেছেন। ফলে গল্পটি রবীন্দ্রনাথের সমাজ ভাবনা ও রাজনীতি ভাবনার সংমিশ্রনে গড়ে ওঠা এক অভিনব গল্পরসে পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে।