উনিশ শতকে ভারতবর্ষে যে তথাকথিত সামাজিক জাগরণের উন্মেষ দেখা গিয়েছিল তার প্রভাব এই বাংলাদেশে পড়েছিল সবচাইতে বেশি। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী মানুষ বিভিন্ন সময়ে সমাজসংস্কারের কাজে স্বেচ্ছায় নিজেদের নিযোজিত করেছিলেন। যদিও এই সংস্কারের সুফল প্রান্তদেশীয় রাজন্যশাসিত রাজ্য কোচবিহারের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ কোনো আলোড়ন ফেলতে সক্ষম হয়নি। সেই সময় কোচবিহার রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল রাজবংশী সম্প্রদায়ভূক্ত। তাঁরা ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু হলেও বর্ণহিন্দুদের সামাজিক ও প্রাত্যহিক কাজকর্ম থেকে ছিলেন চিরতরে ব্রাত্য। সাধারণভাবে হিন্দুসমাজের বর্ণব্যবস্থা হল কর্মভিত্তিক এবং জাতি পরিচয় হল জন্মভিত্তিক। কর্মের প্রচেষ্টার দ্বারা আত্মোন্নতি ঘটানো অনেকাংশেই ব্যক্তির হাতে থাকলেও জন্মগ্রহণ কোনো সময়েই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ থাকে না। জাত্যাভিমানী বর্ণহিন্দুর সমাজ সেই সকল নিম্নবর্ণীয় ব্যক্তিদের কর্মপরিচয়-এর চাইতে তাঁদের গোষ্ঠীপরিচয় বা জন্মপরিচয়কেই সামাজিক যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করাতে বেশি উৎসুক ছিল। উত্তরবঙ্গে বিখ্যাত সমাজসংস্কারক পঞ্চানন বর্মার জীবনপঞ্জি পর্যালোচনা করলেই এই বক্তব্যের সত্যতা আমরা যাচাই করতে পারব।
আকারে ছোটো হলেও কোচবিহার রাজ্য প্রায় 500 বছরের ঐতিহ্য নিয়ে গঠিত • ছিল। প্রায় একই রাজবংশ দ্বারা শাসিত কোচবিহার রাজ্যটি স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল উনিশ শতকে, ব্রিটিশ সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এসে। 1947 সালের 15 আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতালাভ করে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হয়, সেই আইন অনুযায়ী ঠিক হয়, দেশীয় রাজ্যগুলির মতো কোচবিহারও ভারত অথবা পাকিস্তান কোন রাষ্ট্রে যোগদান করবে তা নিজেরাই স্থির করতে পারবে। এই বিষয়ে কোচবিহারের বিভিন্ন দল পরস্পরবিরোধী মতামত প্রকাশের চেষ্টা করতে শুরু করে। প্রথম মতানুযায়ী, কোচবিহার ভারতের সঙ্গে যুক্ত হোক, দ্বিতীয় দলের মতে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হোক; এইসব মতবিরোধের জন্য কোচবিহারের বুকে এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত দেশীয় রাজাদের নবগঠিত ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগদান করার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানান। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে কোচবিহার রাজ্যের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একান্ত অনুরোধে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এক বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষর করে কোচবিহার রাজ্যটিকে 1949 সালের 28 আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রাখার কথা ঘোষণা করেন। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই দেশীয় রাজ্যটিকে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্পণ করেন 1949 সালের 12 সেপ্টেম্বর। চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয় ভারতের গভর্নর জেনারেলের পক্ষে ভারত সরকারের মিনিস্ট্রি অব স্টেটের উপদেষ্টা ভিপি মেনন ও কোচবিহার মহারাজার মধ্যে। এই চুক্তিতে ন-টি ধারা সংযোজিত হয়। চুক্তির বিষয়ে মহারাজা কয়েকটি প্রশ্ন তোলেন। ভারত সরকার প্রদত্ত তাঁর
উক্তিগুলি হল-
① ভারত সরকার বর্তমান কোচবিহার রাজ্যের অঞ্চলগুলিকে একজন প্রধান কমিশনারের
অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে শাসনে বদ্ধপরিকর।
② 12 সেপ্টেম্বর, 1949 থেকে কোচবিহার রাজ্যবাহিনীর দায়িত্ব ভারত সরকার গ্রহণ করবে।
③ মহারাজা এবং শাসক পরিবারের সদস্যদের রাজ্যের রাজস্ব থেকে ভাতা দেওয়া হবে সংযুক্ত তালিকা অনুযায়ী।
④ মহারাজা এবং প্রাসাদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রহরী প্রদান করা হবে।
⑤ কোনো জমি বা ভবন এবং মহারাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হবে না।
⑥ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহারাজার বর্তমান পদ বজায় রাখা হবে। ①)
ভারত সরকার ‘নারায়ণ’ নামটিকে কোচবিহার রাজ্য বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করার
চেষ্টা করবে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাদের অন্তর্ভুক্তির পরেই।
এই চুক্তি সম্পাদনের পর চুক্তির বিষয়ে 17 পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রাজার ভাতা বিষয়ে যেমন শর্ত ছিল অনুরূপভাবে রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্ক অনুসারে বিভিন্ন হারে যে ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তার বিস্তারিত বিবরণ এই চুক্তিপত্রের সঙ্গে সংযোজিত করা হয়। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ সবসময় কোচবিহারের প্রজামণ্ডলীর সুখ ও সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করতেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোচবিহারের জনগণ যাতে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদাসহ বসবাস করতে পারে, সে বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেন।
ভারত সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন দফায় আলোচনা অনুসারে প্রথমে কোচবিহার কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় কোচবিহার রাজ্যটিকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই সময়ে কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে মিটিং-মিছিল আরম্ভ হয় এবং এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে প্রজাহিতসাধনী নামে স্থানীয় একটি দল ব্যাপক আন্দোলন আরম্ভ করে। তৎকালীন পত্রপত্রিকাগুলিতেও সংযুক্তির বিষয়ে জোরালো মত প্রকাশ করা হয়। এই সময়কার সংযুক্তির আন্দোলনের পক্ষে জননেতা উমেশচন্দ্র মন্ডলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অসমের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলইও কোচবিহারে এসে এখানকার জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং অসমের সঙ্গে সংযুক্তির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। তাঁদের ইচ্ছা ছিল কোচবিহার অসমের সঙ্গেই যুক্ত হোক। সব বিতর্কের অবসান হয় 1954 সালের 1 জানুয়ারি। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। কোচবিহার রাসমেলার মাঠে বিরাট জনসভায় ডা. বিধানচন্দ্র রায় কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলারূপে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে স্মরণীয় ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।