রাজ্যসভার গঠন ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

অথবা, ভারতীয় পার্লামেন্টের দ্বিতীয়কক্ষের গঠন ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

রাজ্যসভার গঠন:

ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা পার্লামেন্ট বা সংসদ দ্বিককবিশিষ্ট আইনসভা।’ এর উচ্চকক্ষ বা দ্বিতীয়কজের বায় রাজ্যসভা এবং নিম্নকক্ষ বা প্রথমকক্ষের নাম লোকসভা। ভারতের সংবিধানের ৫০ নং ধারায় বলা হয়েছে যে অনধিক 250 জন সদস্য নিয়ে রাজাসভা গঠিত হবে। এর সদস্যদের দু-ভাগে ভাগ করা যায়-

[1] রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত সদস্য:

রাজ্যসভায় 12 জন সদস্যকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন করেন। সাহিত্য, বিস্তাদ, চারুকলা, সমাজসেবা প্রভৃতি বিষয়ে গ্রুপসম্পন্ন ব্যাক্তিদের মধ্য থেকে এই সদস্যদের রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেন।

তবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারেই তিনি এঁদের মনোনীত করে থাকেন। 2] অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দ্বারা নির্বাচিত সদস্য: অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে 238 জন সদস্য নির্বাচিত হন। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের আইনসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ একক হস্তান্তরযোগ সমানুপাতিক ভোট পদ্ধতির দ্বারা রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচিত করেন। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে যেসব প্রতিনিধি রাজাসভায় আসেন তাঁরা একটি নির্বাচক সংস্থা (Electonal Collage)-র দ্বারা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচক সংস্থাও একক হস্তান্তরযোগ্য সমানুপাতিক ডোষ্ট পদ্ধতির দ্বারা রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচিত করেন। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে রাজ্যসভায় সদস্যদের নির্বাচন সম্পর্কিত পদ্মতি সংসদ আইন করে ঠিক করে দেয়। সংবিধানে 84 নং ধারায় রাজ্যসভার সদস্য হতে গেলে যে যে যোগ্যতা প্রয়োজন তার উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে-

[a] নাগরিকত্ব: প্রার্থীকে অবশ্যই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।

[b] বয়সসীমা: প্রার্থীর বয়স হতে হবে কমপক্ষে ১০ বছর।

c] যোগ্যতা নির্ধারণ: সংসদ অহিনপ্রণয়নের দ্বারা যেসব যোগ্যতা ঠিক করে দেবে প্রার্থীকে সেইসব যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে।

রাজ্যসভায় পদাধিকার বলে উপরাষ্ট্রপতি চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন।

রাজ্যসভার কার্যাবলি:

রাজ্যসভা হল কেন্দ্রীয় আইনসভা তথা সংসদের দ্বিতীয়কক্ষ। নিম্নকক্ষ লোকসভার মতো ক্ষমতা ও মর্যাদা রাজাসা ভোগ করে না। রাজ্যসভার উল্লেখযোগ্য কাজগুলি হল-

[1] আইনপ্রণয়নমূলক কার্যাবলি:

কেবল অর্থ বিল ছাড়া সাধারণ বিল পাসের ক্ষেত্রে রাজ্যসভা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। সাধারণ বিল রাজ্যসভা অথবা লোকসভা-যে-কোনো করেই উত্থাপন করা যায়। কোনো বিল যদি লোকসভায় গৃহীত হয় এবং গৃহীত বিলটিকে যদি রাজ্যসভা প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তা আইনে পরিণত হবে না। আবার সাধারণ বিলের ক্ষেত্রে অর্থাৎ অর্থ বিল ছাড়া অন্য যে-কোনো বিলের ক্ষেয়ে যদি লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয় তাহলে তা দূর করার জন্য রাষ্ট্রপতি একটি যৌথ অধিবেশন ডাকেন। এ যৌথ অধিবেশনে লোকসভার স্পিকার সভাপতিত্ব করেন। এই যৌথ অধিবেশনে লোকসভা তার সংখ্যাগরিষ্ঠের শক্তিতে জয়ী হয়। আবার কোনো বিল সম্পর্কিত ব্যাপারে মতভেদ দেখা দিলে যৌথ অধিবেশন

ডাকার ব্যাপারটিও মন্ত্রীসভার হাতে থাকে। তাই বলা যায় যে সেক্ষেত্রে রাজ্যসভার আইনপ্রণয়নের ক্ষমতা বিশেষভাবে স্কুল হয়েছে।

[2] সরকার গঠনমূলক কার্যাবলি:

রাজ্যসভা সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ভোগ ना। মূলত সংসদীয় ব্যবস্থার রীতি অনুসারে জনপ্রিয় কন্ধের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। আবার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রপতির দ্বারা অন্যান্য মন্ত্রীরা নিযুক্ত হন। অতএব ভারতে রাজ্যসভায় কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর নির্ভর করে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। তবে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীপরিষদ গঠনের সময় রাজ্যসভা থেকে নিজ দলের কোনো সদস্যকে অথবা জোটের কোনো

সদস্যকে মন্ত্রীসভায় রাখতে পারেন। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী রাজ্যসভার কোনো সদস্যকে বিশেষ কোনো দফতরের দায়িত্বও দিতে পারেন।

[3] নির্বাচনমূলক কার্যাবলি:

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় লোকসভা ও রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য ছাড়া অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যরা সমান ক্ষমতা ভোগ করেন। আবার উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় যে নির্বাচক সংখ্যা গঠিত হয় তাতে রাজ্যসভা ও লোকসভা উভয় কক্ষেরই সদস্য থাকনে। অর্থাৎ রাজ্যসভা ও লোকসভার সদস্যরা রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় সমান ক্ষমতা ভোগ করে।

[4] রাজা তালিকাভুক্ত বিষয়ক কার্যাবলি:

জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে সংসদকে রাজ্যতালিকাভুক্ত কোনো বিষয়ে আইনপ্রণয়নের জন্য যদি রাজ্যসভা উপস্থিত ও ভোট প্রদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করে তাহলে রাজ্য তালিকাভুক্ত সেই বিষয়ে সংসদ আইনপ্রণয়ন করতে পারবে [249(1) নং ধারা)।

[5] সর্বভারতীয় চাকরি সৃষ্টি বিষয়ক কার্যাবলি:

জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে যদি এক বা একাধিক চাকরি সৃষ্টি করার প্রয়োজন আছে বলে রাজ্যসড়া মনে করে এবং যদি ওই সভায় উপস্থিত ও ভোট প্রদানকারী সদস্যদের দুই- তৃতীয়াংশের সমর্থন দ্বারা প্রস্তাবটি গৃহীত হয় তাহলে সংসদ সে বিষয়ে আইনপ্রণয়ন করতে পারে [312 নং ধারা]।

[6] সংবিধান সংশোধনমূলক কার্যাবলি:

রাজ্যসভা ও লোকসড়া সংবিধান সংশোধনের ক্ষেয়ে উভয়েই সমান ও পুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত প্রস্তাব রাজ্যসভা অথবা লোকসভা-যে-কোনো কক্ষে উত্থাপিত হতে পারে। কেবল লোকসভায় উত্থাপিত হলেই তা কার্যকর হবে না। অর্থাৎ সংविधान সংশোধন বিল উত্তয়কক্ষ দ্বারা গৃহীত না হলে সংশোধন বিলটি বাতিল হয়ে যাবে। আবার যদি বিলটি একষ্টিকক্ষে গৃহীত হয় এবং অপরকন্ধ তা বাতিল করে, তাহলে সেরূপ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যৌথ অধিবেশন ডেকে বিরোধের বা মতভেদের বিষয়টি দূর করতে পারবেন কি না সে সম্পর্কে সংবিধানে কোনো নির্দেশ নেই।

[7] জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত কার্যাবলি;

জাতীয় জরুরি অবস্থা সং ক্লান্ড মোষণা সংসদ দ্বারা অনুমোদিত হতে হয়। সংসদ অনুমোদন না করলে তা একমাসের বেশি বজায় থাকবে না। জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ঘোষণার প্রস্তাবটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও লোকসভা উভয়ই সমান ক্ষমতা ভোগ করে। উভয়কক্ষে যদি ওই প্রস্তাব গৃহীত না হয় তাহলে তা বাতিল হয়ে যায়, কার্যকর হয় না। তবে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে লোকসভার ক্ষমতা বেশি। জরুরি অবস্থা ঘোষণা থাকাকালীন সময়ে মৌলিক অধিকারের প্রয়োগ যাতে স্থগিত রাখা হয় তার জন্য রাষ্ট্রপতির আদেশ অথবা মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত বিল প্রভৃতি ক্ষেত্রে উভয়কক্ষেরই অনুমোদন দরকার হয়।

অপসারণগত কার্যাবলি:

লোকসভা ও রাজ্যসভা রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিগণ প্রমুখকে অপসারণের ক্ষেত্রে সমান ক্ষমতা ভোগ করলেও উপরাষ্ট্রপতিকে অপসারণ সংক্রান্ত প্রভাব রাজ্যসভায় প্রথম উত্থাপন করতে হবে।

মূল্যায়ন:

রাজ্যসভা কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষ দ্বিতীয়কক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি অনুসারে উচ্চকক্ষে সম্প্রতিনিধিত্ব থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ভারতে রাজ্যসভা গঠনের ক্ষেত্রে সমপ্রতিনিধিত্বের নীতিটি স্বীকৃত হয়নি। এখানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। সুতরাং গঠনগত দিক থেকে এর ত্রুটি যথেষ্ট। কারণ যে রাজ্যের জনসংখ্যা যত বেশি হবে সেই রাজোর প্রতিনিধির সংখ্যাও তত বেশি হবে। ফলে যে রাজোর প্রতিনিধির সংখ্যা বেশি হবে সেই রাজ্যের প্রতিনিধির ক্ষমতাও তত বেশি বলাবাড়ুল্য। গঠনগত দিক থেকে রাজ্যসভার ছুটি থাকলেও এতে একেবারে অপ্রয়োজনীয় কঙ্কবলা যায় না। কারণ, সাধারণ বিল পাস, সংশোধনী বিল পাসের ক্ষেত্রে, জরুরি অবস্থ সংক্লান্ত প্রভাবের ক্ষেত্রে উভয় কন্ধই সমান ক্ষমতার অধিকারী। আবার দুটি বিশেষ ক্ষেত্রে রাজ্যসভার যে পুরুত্বপূন ক্ষমতা আছে তা উল্লেখযোগ্য। যেখন জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে রাজ্যতালিকাভুত বিষয়ে কোনো আইনপ্রণয়নের জন্য সংসদকে অনুরোধ করা এবং All India Services-এর ক্ষেত্রে নতুন পদ সৃষ্টির ব্যাপারে ভূমিকা। কাজেই সংসনীয় ব্যবস্থায় রাজ্যসভা অপ্রয়োজনীয় পরিষদ নয়। এটি একটি কার্যকর সভা বলা যায়।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading