রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে উদারনৈতিক ভূমিকা: –
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত মতবাদের মধ্যে উদারনৈতিক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এই মতবাদ ব্যক্তির চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর জোর দেয়, ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপায় হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে বিবেচনা করে এবং রাষ্ট্রের কার্যাবলীকে সীমিত করে এবং উদারনৈতিকবাদ বলা হয়।
সনাতন উদারনৈতিক মতবাদ: –
জন স্টুয়ার্ট মিলের পূর্ববর্তী উদারনৈতিকবাদকে ‘সনাতম উদারনৈতিকবাদ’ একে চিহ্নিত করা হয়। জন লক্, বেন্থাম, অ্যাডাম স্মিথ, জেমস্ মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বার্ট স্পেনসার প্রমুখ।
সনাতন উদারনৈতিকবাদের মূল্য বক্তব্য: –
প্রথাগত উদারনৈতিকবাদের মূল কথা হল রাষ্ট্র চরম, চূড়ান্ত ও অসমী ক্ষমার অধিকারী নয়। বরং, রাষ্ট্র যত কম শক্তি প্রয়োগ করবে এবং ব্যক্তিজীবনকে যত কম নিয়ন্ত্রণ করবে, ব্যক্তির তত ভালো হবে। সংক্ষেপে, রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির কল্যাণ ও অধিকার রক্ষা করা। ব্যক্তি যাতে সর্বোচ্চ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতামত: –
ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান লক্-এর চিন্তাধারায় সনাতন উদারনৈতিক মতবাদের যে বক্তব্য পাওয়া যায় তা হল (I) ব্যক্তি সাধারণের কল্যাণ সাধনের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রয়েছে; (II) জনসাধারণের সম্পত্তিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, (III) সাংবিধানিক সরকার আইনের অনুশাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
অ্যাডাম স্মিথের মতে, রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকবে। তাই তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, প্রতিরক্ষা, সর্বপ্রকার অন্যায় অত্যাচারের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা ইত্যাদি কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, ব্যক্তির নৈতিক উন্নতিসাধন করা হল রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য। তিনি রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় অথচ ক্ষতিকারক বলে মনে করতেন। ব্যোমের মতে, রাষ্ট্রের লক্ষ হল সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ কল্যাণ সাধন করা। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তি তার নিজের কল্যাণ সাধনে সক্ষম, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কোনো প্রশ্ন নেই।
উক্ত সনাতন উদারনৈতিকবিদরা সকলেই ব্যক্তি স্বাধীনতার সংরক্ষণ ও ব্যক্তির কল্যাসাধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এছাড়া তাঁরা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বা নিয়ন্ত্রণের বিচারাধীন ছিলেন।
আধুনিক উদারনৈতিক মতবাদ: –
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভাব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে এবং কয়েকটি বণিক শ্রেণীর হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভূত হয়। ফলে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমা হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে T. H. Green, M. R. ম্যাকআইভার, হ্যারল্ড ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ রাজনৈতিক চিন্তাবিদ নেতিবাচক রাষ্ট্র ধারণার পরিবর্তে ইতিবাচক রাষ্ট্র ধারণার উপর জোর দেন। তাই, আধুনিক উদারনৈতিকে কখনও কখনও ইতিবাচক উদারতাবাদ বলা হয়।
গ্রিনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র: –
গ্রিনের মতে, রাষ্ট্র নিজেই নিজের লক্ষ্য তা হল রাষ্ট্রগঠনকারী মানুষের পরিপূর্ণ নৈতিক বিকাশের হাতিয়ার। তবে রাষ্ট্র যদি মানুষের নৈতিক বিকাশের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার বিরোধিতা করা নাগরিকের কতব্য।
বহুত্ববাদীদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র: –
ম্যাকাইভার, ল্যাস্কি, বার্কারের মতো আধুনিক উদারনৈতিকবাদরা রাষ্ট্রকে বহুত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তাদের মতে, রাষ্ট্র ছাড়াও সমাজে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন রয়েছে। তাই রাষ্ট্র কখনোই তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক এক নয়। কারণ রাষ্ট্র তার আইনগত অধিকারের মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
সমালোচনা: –
সতেরো শতক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে উদারনৈতিকবাদ এখনও বিশেষভাবে স্বীকৃত। তবে এই মতবাদের বিষয় কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছে। যথা
A) পরস্পর বিরোধী ধারণা: –
উদারনৈতিক মতবাদের মধ্যে পরস্পর-বিরোধী ধারণা পরিলক্ষিত হয়। এই মতবাদ একদিকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অন্যদিকে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে স্বীকার করেছে।
B) অস্পষ্টতা: –
উদারনৈতিক মতবাদ অত্যন্ত নমনীয়। এই কারণে অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট। উদারনৈতিকবিদদের চিন্তা ভাবনার মধ্যে বৈচিত্র থাকার জন্য উদারনৈতিক যথার্থ স্বরূপ অনুধাবন করা কঠিন।
C) রক্ষণশীল তত্ত্ব: –
উদারনৈতিক মতবাদের মধ্যে রক্ষণশীলতা পরিলক্ষিত হয়। তাই উদারনৈতিকবিদদের কেউই সমকালীন বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে এড়িয়ে যেতে পারেনি।
D) ব্যর্থ ধারণা: –
সমালোচকদের মতে, উদারনৈতিকবিদরা জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধনের যে পরিকল্পনা পেশ করেন সেখানেও তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে।
E) সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত নয়: –
সমালোচকদের মতে, নয়ার উদারনৈতিকবাদ ব্যক্তি স্বতন্ত্রবাদী ও ভোগবাদী ধ্যান-ধারণার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত নয়।
F) সম্যক ধারণার অভাব: –
নয়া উদারনৈতিকবাদী বক্তব্যে স্বাধীনতার ধারণা সাম্যের ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত কিনা সে বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায় না।
G) বুর্জোয়া শ্রেণির স্বাধীনতা: –
উদারনৈতিকবাদ যে অবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মুক্ত অর্থনীতির কথা বলে, সেই স্বাধীনতা হল মূলত তৎকালীন উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণির।
মন্তব্য: –
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে উদারনৈতিক অনেক সমালোচনা থাকা সত্বেও উদারনৈতিক নিঃসন্দেহে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। এই মতবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে এবং রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশের মাধ্যমে মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।