লোক সংস্কৃতি কি? লোক সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

লোক সংস্কৃতি কি?

লোক সংস্কৃতি হলো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত  তাদের চিন্তায় ও কর্মের ঐতিহ্যনুসারে বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্টীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান, জীবন-যাপন প্রণালী, শিল্প ও বিনোদন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা সংস্কৃতিকে সহজ ভাষায় লোকসংস্কৃতি বলা হয়।

আরও সহজ ভাবে বললে লোক সংস্কৃতি হলো কোনো নিদির্ষ্ট এলাকায় বসবাস রত মানুষের মুখে মখে প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাস , আচার, রীতি-নীতি ও তাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টিই হলো লোক সংস্কৃতি।

লোকসংস্কৃতি ইংরেজি:

লোকসংস্কৃতি ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Folklore । লোকসংস্কৃতি বা লোককতি’ শব্দটির ইংরেজি পরিভাষা

FOLKLORE । ১৮৪৬ সালের ‘লোকসংস্কৃতি বোঝাতে Popular Antiqity এবং ‘লোক সাহিত্য বোকাতে Popular Literature পরিভাষা প্রচলন ছিল। তবে এ দুটি শব্দের উৎপত্তি ইংলন্ডে। ১৮৬৫ শ্রী এডওয়ার্ড টাইলার লোক সংস্কৃতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করেন।

লোক সংস্কৃতি বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি:

অধ্যাপক ড. তুষার চট্টোপাধ্যায় তাঁর “লোক সংস্কৃতির তত্বরূপ ও স্বরূপ সন্ধান” গ্রন্থে “লোকসংস্কৃতির” সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন “লোকসংস্কৃতি লোকায়ত সংহত সমাজের সমষ্টিগত প্রয়াসের জীবনচর্যা ও মানসচর্চার সামগ্রিক কৃতি ; যা মূলত তথাকথিত আদিম সমাজে অমার্জিত সাংস্কৃতিক প্রয়াস ও অগ্রগতি সমাজের সুমার্জিত বিদগ্ধ সংস্কৃতি অপেক্ষা কমবেশী স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ্বতত্্ শিক্ষাগত, অতিপ্রযত্ব নিরপেক্ষ প্রধানত :

এতিহ্যাশ্রয়ী বাকভাষা – অঙ্গভাষা, কারুভাষা- চারুকলা, পোষাক পরিচ্ছেদ, রান্নাবান্না, সুচ্ছন্দ, ক্রীড়া অভিনয়, উষধ, তুকতাক, প্রথা উৎসব, বিশ্বাস-সংক্রান্ত, ধর্ম-অনুষ্ঠান, মেলাপার্বন ইত্যাদিতে অভিব্যক্ত ; এবং ক্ষেত্রানুসারে সৃষ্টিশীল সক্রিয়তার মূর্ত বা বিস্মৃতিতে অবলুপ্ত হলেও ; সামগ্রিকভাবে সামাজিক স্বন্ধপাতের সচলতায় আদিম সমাজের হারানো অতীতে মূল প্রোথিত করে বিবর্তনের ধারায় চলমান কালের সত্যে উদ্ভাসিত হয়ে আগামী দিনের বাতাবরনে সম্প্রসারিত।” যে কোন সমাজ সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান পরিচয় হল –

শিল্প-ভাক্ষর্য-সাহিত্য । একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে আহিত্যের মাধ্যমেই সংস্কৃতির স্বরূপ উদঘাটিত হয়ে থাকে সেখানে উচ্চ সংস্কৃতির সঙ্গে নিন্ম সংস্কৃতির এক সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় । তাই অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় যে, একটা অন্ত্যজ মানুষের জীবন যাত্রার সাথে লোকসংস্কৃতির উপাদান গুলি ওত প্রোত ভাবে জড়িত। সেই লোক সংস্কৃতির উপাদান গুলিকে আমরা মোটামুটি নিন্ম লোখিত ভাগে ভাগ

লোক সংস্কৃতির উপাদান | বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির উপাদান

লোকসংস্কৃতি ভাগ বা উপাদান নিছে দেয়া আছে-

লোক সংস্কৃতির উপাদান :

(১) বন্তুকেন্দ্রিক

(২) বিশ্বাস অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক

(৩) খেলাধূলা কেন্দ্রিক

(৪) বাক্কেন্দ্রিক

(৫) অঙ্গ-ভঙ্গি কেন্দ্রিক

(৬) লিখন বা অঙ্কন

কেন্দ্রিক।

লোক সংস্কৃতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য:

(ক) লোক সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে পল্লীজীবন বা গ্রামীন জীবন কথা চিত্রে ধরা

পড়ে। কৃষিসমাজই এর প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র।

(খ) সংহত বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ এর অবলম্বন ।

(গ) লোকসংস্কৃতির ্র্টা সাধারণ সমষ্টি বা গোষ্ঠী বদ্ধ মানুষ ।

(ঘ) লোকসংস্কৃতির সৃষ্টি সাহিত্য মূলত নিরক্ষর মানুষের সৃষ্টি । এই সাহিত্য

অলিখিত।

(ড) লোক সংস্কৃতির অষ্টা বা রচয়িতার নাম পাওয়া যায় না।

(চ) লোকসংস্কৃতি মাধ্যম মৌখিক।

(ছে) লোকসংস্কৃতি ুলত স্মৃতি ও রতি নির্ভর

(জ) লোকসংস্কৃতি প্রাণের তাগিদে স্বতস্ফূর্ত রচনা।

(বে) সরল, অকৃত্িম ও আটপৌরে সৃষ্ট এটি।

(ঞ) লোক সংস্কৃত মূলত তিহা নির্ভর।

(ট) লোক সংস্কৃতি বিবর্তনধ্মী এবং নমনীয়

লোকসংস্কৃতির উদাহরণ

লোকসংস্কৃতির উদাহরণ বলতে গেলে বলতে হয়  লোকসংস্কৃতির মানুষের মুখে মুখে যে কৃষ্টি লালিত হয় সেগুলোই। যেমনঃ রীতি-নীতি, কথা, ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার- ব্যবহার, প্রথা, ইত্যাদি।

লোকসাহিত্য কি?

লোকসাহিত্য কী? বাংলায় আমরা যাকে লোকসাহিত্য বলি, তা ইংরেজি ‘Folklore’ কথাটির অনুবাদ প্রতিশব্দ নয়। ইংরেজি ‘Folklore’ কথাটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজিতে ‘Folklore’ বলতে যা বুঝায় তা স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত : (1) Material folklore বা লোক-শিল্প এবং (২) Formalised Folklore বা লোকসাহিত্য। আমাদের লোকসাহিত্যকে বরং Formalised Folklore-এর প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণ করা যেতেপারে। লোকসাহিত্য হচ্ছে গ্রামীণ পরিবেশে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের সৃজনধর্মী, কল্পনাপ্রবণ, সৌন্দর্যপিপাসু ও ব্যবহারিক জ্ঞানের কাব্যিক ও গদ্যধর্মী বহিঃপ্রকাশ। মৌখিক মাধ্যমে পরিভ্রমণ ও গদ্যধর্মী বহিঃপ্রকাশ। মৌখিক মাধ্যমে পরিভ্রমণ প্রবণতা এর প্রধান লক্ষণ। কল্পনা ও সৃজনশীলতার সংমিশ্রণে লোকসাহিত্য সৃষ্টি হলেও গ্রাম্য কবির বাস্তব অভিজ্ঞতা এর মৌলধর্মে বিদ্যমান। আদিম মানুষের চিন্তা-চেতনা ও সংস্কার-বিশ্বাস গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে লোকসাহিত্যে।

ডক্টর মযহারুল ইসলাম বলেছেন- যে সাহিত্য সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে এসেছে, এখনো প্রচলিত আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে, সেগুলোই লোকসাহিত্য।’১১ লোকসাহিত্যের অধিকাংশ উপাদানের স্রষ্টা ব্যক্তি, অর্থাৎ একজন, তবে সেই একজনের সম্পদ সমগ্র জাতির সম্পদে পরিণত হলে তবেই তা হয়ে ওঠে লোকসাহিত্য।

লোকসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য কি কি

লোকসাহিত্য’ নিরক্ষর মানুষ নিয়ে গঠিত-যা সমাজ, কৃত্রিম সভ্যতার প্রভাবমুক্ত, সেই সমাজের সামগ্রিক জীবনবোধ ও মানসিকতার দ্বারা রচিত।৷

দ্বিতীয়ত, লোকসাহিত্য সংহত সমাজের সামগ্রিক সৃষ্টি। সংহত সমাজের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে ব্যষ্টির কোনো দাবি স্বীকৃত হয় না, সমষ্টির বা সামগ্রিক দাবিই সেখানে স্বীকৃত হয়। ব্যক্তি বিশেষ সেখানে কিছুই নয় সমষ্টির জন্যই তার অস্তিত্ব ৷

(তৃতীয়ত, লোকসাহিত্য ব্যষ্টি ও সমষ্টির সমবেত সৃষ্টি; ব্যষ্টির মনে যে ভাবের উদয় হয় তার অসম্পূর্ণ রূপায়ণকেই সমষ্টি নিজের আদর্শে সম্পূর্ণ করে নেয়।

চতুর্থত, ব্যক্তি বিশেষের অপরিণত রচনা সমষ্টির হাতে পড়ে উন্নতিই লাভ করে, অধোগতি লাভ করে না।

পঞ্চমত, লোকসাহিত্য কেউ লিখে রচনা করতে পারে না; যখন এর উদ্ভব হয়, তখন এ মুখে মুখেই রচিত হয় এবং প্রথম অবস্থায় এ মুখে মুখেই প্রচারিত হয়।

ষষ্ঠত, লোক-সাহিত্যের প্রধান ধর্মই এই যে, এটা সজীব-এর ধারা ক্রমপরিবর্তনের ভেতর দিয়েই অগ্রসর হতে থাকে, মৌখিক আবৃতি ও পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে এর জীবন শক্তি রক্ষা পায় কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের বদ্ধকুণ্ডে যদি এটা গিয়ে রুদ্ধ হয়ে পড়ে, তবে অচিরেই এর প্রাণ-শক্তি লুপ্ত হয়ে যায়।

সপ্তমত, লোকসাহিত্যের কোনো লিখিত রূপের ভেতর দিয়ে তার প্রকৃত রস কিছুতেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয় না।

অষ্টমত, লোকসাহিত্যের অধিকাংশ বিষয়ই সমসাময়িক কোনো সমাজ কিংবা ব্যক্তি কর্তৃক উদ্ভাবিত ও রচিত হওয়া অসম্ভব। কারণ, সমাজের মধ্যে লোকসাহিত্য বিকাশ লাভ করতে দেখা যায়, জন্মলাভ করতে দেখা যায় না। নবমত,

নবমঃ লোকসাহিত্য চিরন্তন মানবিক বৃত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেই রচিত হয়।

দশমত, লোকসাহিত্য নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের অধীন নয়।

একাদশত, লোকসাহিত্যের প্রকাশ সংক্ষিপ্ত।

দ্বাদশত, লোকসাহিত্য জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে রচিত হয়।

প্রয়োদশত, অর্থ প্রকাশের পরিবর্তে রস-সৃষ্টিই লোকসাহিত্যের লক্ষ্য।

চতুর্দশত, লোকসাহিত্যের ঢঙ ও স্টাইল সাহিত্যের ঢঙ ও স্টাইল থেকে ভিন্ন। সে যা বলতে চায়, রেখে ঢেকে বলে না, সবই বলে দেয়।

পঞ্চদশত, লোকসাহিত্যের ভাষা লোকদের নিত্যব্যবহার্য ভাষার ওপরে একান্তভাবে নির্ভরশীল। সাধারণ মানুষের বোধগম্যতাই তার আসল লক্ষ্য। তার পোশাক যেমন আটপৌরে, ভাষাও তেমনি সাদাসিধে।

লোকসাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা বলতে কি বোঝ

লোকসাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা আমরা দীর্ঘকাল ধরে লিখিত সাহিত্যের আলোচনা ও তার বিচার-বিশ্লেষণেই নিজেদের পরিতৃপ্ত রেখেছিলাম। অলিখিত বা মৌখিক সাহিত্য বিষয়ে দৃকপাত করার কোনো প্রয়োজনই আমরা দীর্ঘকাল ধরে অনুভব করিনি। ব্যক্তিমনের সচেতন প্রয়াসে সৃষ্ট সাহিত্য প্রকাশের তাগিদ ব্যতীত খ্যাতি ও অর্থের কারণে রচিত হয়। তাই রচয়িতা তাঁর রচিত সাহিত্যের প্রচারে নিজে থেকেই তৎপর হন। কিন্তু মৌখিক সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য নিছক সহজ কবিত্ব শক্তি প্রকাশের আনন্দেই নিঃশেষিত। তাই প্রচারের তাগিদ সেখানে অনুপস্থিত। তবু অল্প কিছুকাল আগে বিশেষভাবে জাতীয়তাবোধের দ্বারা উদ্দীপিত হয়ে শিক্ষিত মানুষ উপলব্ধি করলেন লিখিত সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে মৌখিক সাহিত্যের পরিচয় ও আস্বাদ গ্রহণ না করলে জাতির সাহিত্য আলোচনা ও তার রসাস্বাদন অসম্পূর্ণতা দোষে দুষ্ট থেকে যায়। তাই নিজেদের প্রয়োজনে আমরা নিরক্ষর মানুষের রচিত মৌখিক

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading