সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের সম্পর্কে কী জানো লেখো। (Write what do you know about Sannyasi-Fakir’s Rebellion.)  অথবা, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের গুরুত্ব আলোচনা করো। (Discuss the significance of Sannyasi-Fakir’s Revolt.

1757 সালে একদল স্বার্থপর, লোভী, কুচক্রী, দেশদ্রোহী মুসলমান-হিন্দু-মারোয়াড়ি মুৎসুদ্দীর ক্ষমতালিপ্সাকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা বাংলার দখল নেয়, এই দেশের সম্পদ লুঠ করার জন্য। কিন্তু মাত্র চার বছর পার না-হতেই 1761 সালে বাংলার ফকির ও সন্ন্যাসীরা গ্রামের গরিব কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে ইংরেজ কোম্পানির নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সর্বপ্রথম উত্তরবঙ্গে। এদের সঙ্গো যোগ দিয়েছিল সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া পুরোনো ভূস্বামীদের একাংশ।

WW Hunter সাহেবের ‘The Annals of Rural Bengal’ নামক গ্রন্থে প্রদত্ত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, 1770 সালের মহা মন্বন্তরে বাংলার এক কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ অন্নাভাবে মারা যায়। শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, শাসকের সীমাহীন লোভ, কর আদায়ের জন্য জমিদারদের নিষ্ঠুর অত্যাচারও-এর জন্য দায়ী ছিল। দায়ী ছিল মজুতদার এবং সুদখোর মহাজনদের নির্মম শোষণও। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রথম পর্বে সেই সময়কার বাংলার ভয়াবহ অবস্থার মর্মভূদ বিবরণ রয়েছে। তাঁর দেওয়া বিবরণ হান্টার সাহেবের বই থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। ফকির-সন্ন্যাসীরা তাঁদের বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, বীরভূম, ময়মনসিংহসহ বেশ

কয়েকটি জেলায়। সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের মাধ্যমে বাংলার দরিদ্র কর্ষণজীবী হিন্দ-মুসলমানেরা সম্মিলিতভাবে এদেশে ইংরেজ শাসনের উষালগ্নেই যে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা যে-কোনো দেশের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। সেদিন এই বিদ্রোহের নায়কেরা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের যে পথ দেখিয়েছিলেন তা যদি আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ দিনগুলি পর্যন্ত বজায় রাখা সম্ভব হত, তাহলে ভারতের ইতিহাসটাই পালটে যেত। যাই হোক, মজনু শাহ, মুসা শাহ এবং ভবানী পাঠক, গণেশ গিরি, চেরাগ আলি, দেবী চৌধুরানী, সোভান আলি, পরাগল শাহ এবং অন্যান্য ফকির-সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে প্রায় 25 হাজার দুর্গত মানুষ সে সময়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানায়। তারা কর প্রদান বন্ধ করে; থানা, ট্রেজারি আক্রমণ ও লুঠ করে। ফলে ব্রিটিশ রাজশক্তি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং যে-কোনো উপায়ে মজনু শাহকে গ্রেপ্তার এবং কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার জন্য দিনাজপুরের রাজাকে নির্দেশ পাঠায়। কিন্তু গর্বোশ্বত ইংরেজরা কোনোদিনই মজনু শাহকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বাংলা, বিহার, আসামের একটা বড়ো অংশকে কাঁপিয়ে দিয়ে 1787 সালে উত্তরপ্রদেশের কানপুরের কাছে মজনু শাহের মৃত্যু হয়। তারপরেও অষ্টাদশ শতাব্দীর নয়ের দশক পর্যন্ত সন্ন্যাসী-ফকিররা ইংরেজ শাসনকে তটস্থ রেখেছিলেন। বিভিন্ন জেলাশাসকদের পাঠানো বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সরকারি কোশাগার এবং অত্যাচারী জমিদার-মহাজন, রাজা-মহারাজাদের ধনসম্পদ লুঠ করলেও সন্ন্যাসী-ফকিররা কোনোদিন কোনো কৃষক বা গরিব মানুষের টাকা লুঠ করেননি বা তাদের ওপর কোনোরকম অত্যাচার চালায়নি। এই কারণেই সন্ন্যাসী-ফকিরদের জনভিত্তি ছিল এত শক্তিশালী এবং সেজন্যই দীর্ঘকাল ধরে তাদের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো সম্ভব হয়েছে। সামান্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে 38 বছর ধরে ইংরেজদের নাস্তানাবুদ করার পর উন্নততর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী রাজশক্তির কাছে সন্ন্যাসী-ফকিররা পরাস্ত হলেও তাঁবাই ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পথপ্রদর্শক। তাঁদের পরাজয়ের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল আগামীদিনের জয়ের বার্তা। ভয়-ভাঙানো সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ বন্ধদুয়ার ভেঙে আন্দোলনের, বিদ্রোহের যে উৎসমুখ খুলে দেয়, তারই পথ ধরে গোটা উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে একের পর এক কৃষক বিদ্রোহ বাংলার বুকে আছড়ে পড়ে। মেদিনীপুরের কৃষক বিদ্রোহ (1766- 83), ত্রিপুরা জেলার সমশের গাজির বিদ্রোহ (1767-68), নোয়াখালি জেলার সন্দীপের বিদ্রোহ (1769), রংপুর জেলার কৃষক বিদ্রোহ (1783), বীরভূমের গণবিদ্রোহ (1784- 86), ময়মনসিংহের দুটি পাগলপন্থী বিদ্রোহ (1825-27 এবং 1832-33), গারো বিদ্রোহ (1838-82), ওয়াহাবি (1831) ও ফরাজি আন্দোলন (1838-48), ইতিহাসখ্যাত সাঁওতাল বিদ্রোহ (1855-57), 1857 সালের মহাবিদ্রোহ তথা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, নীলচাষিদের বিদ্রোহ (1859-61), পাবনার কৃষক বিদ্রোহ (1872-73) এরকমই কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এর সবগুলিই মূলত কৃষক বিদ্রোহ। 1857 সালের মহাবিদ্রোহে বঞ্চিত, প্রতারিত, ক্ষুদ্ধ রাজন্যবর্গের নেতৃত্ব থাকলেও এই বিদ্রোহের মূল শক্তি ছিল সিপাহিরা-এরা আর কিছু নয়, উর্দিপরা কৃষক। জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কিংবা জমির আয় থেকে সংসার চালাতে ব্যর্থ হয়ে এঁরা সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কৃষকের বেদনাই তাঁদের সর্বদা ক্ষুব্ধ করে রাখত এবং এই বেদনাই মুখ্যত তাঁদের মহাবিদ্রোহে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিল। একের পর এক এইসব বিদ্রোহ পরবর্তীকালের সংগ্রামী মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে, তাদের চিন্তাচেতনাকে শাণিত করেছে, শিখিয়েছে নতজানু না-হয়ে নিঃশেষে আত্মদানের আদর্শকে। তাই বলতেই হয় যে, এইসব বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, আন্দোলন পরবর্তীকালের বহুবিধ সংগ্রামের জন্য জমি তৈরি করে দিয়ে গেছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading