সমষ্টিগত নিরাপত্তার অর্থ ও সুরক্ষা–
অর্থ: সমষ্টিগত নিরাপত্তা (Collective Security) একটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধারণা যা রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে চায়, যেখানে এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ হলে, অন্য সব রাষ্ট্র মিলে সেই আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাবে। এর মূল ধারণা হলো, যদি একটি রাষ্ট্র অন্য একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসন করে, তবে অন্য সব রাষ্ট্র ঐ আক্রমণের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করবে এবং আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক নিরাপত্তার অনুভূতি সৃষ্টি করে, যাতে কোনো একক রাষ্ট্রের দ্বারা আক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায়। সমষ্টিগত নিরাপত্তা কূটনীতির মাধ্যমে একটি বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করে।
সমষ্টিগত নিরাপত্তার মূল বৈশিষ্ট্য:
- সামूहিক প্রতিক্রিয়া: একক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ হলে অন্য সব রাষ্ট্র ঐ আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাবে। এটি কোনও নির্দিষ্ট জোটের ব্যাপারে নয়, বরং একটি বৈশ্বিক ধারণা যেখানে সমস্ত রাষ্ট্র একত্রে কাজ করবে।
- আন্তর্জাতিক আইন ও সংস্থাগুলির ভূমিকা: সমষ্টিগত নিরাপত্তা প্রক্রিয়া সাধারণত আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘ (UN) এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। জাতিসংঘের চার্টারের অধীনে, সদস্য রাষ্ট্রদের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঘটনা ঘটলে, তা মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একত্রে কাজ করতে পারে।
- বিশ্ব শান্তি রক্ষার প্রচেষ্টা: সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো বিশ্ব শান্তি বজায় রাখা, যাতে কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানোর আগ্রহ বা ক্ষমতা না পায়।
সুরক্ষা: সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কিছু মূল দিক রয়েছে:
- বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা: রাষ্ট্রগুলি একে অপরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করবে। এর মাধ্যমে কোন একক রাষ্ট্রের আক্রমণের ফলে বৃহত্তর সংঘর্ষ বা যুদ্ধের ঝুঁকি কমানো যায়।
- অন্তর্ভুক্তি: সমষ্টিগত নিরাপত্তার মধ্যে সব রাষ্ট্রকেই অন্তর্ভুক্ত করতে হয়, যেহেতু এটি কেবল তখনই কার্যকর যখন সব রাষ্ট্র এতে অংশ নেবে এবং তাদের সামরিক বা কূটনৈতিক শক্তি একত্রিত করবে।
- বিরোধ নিষ্পত্তি: সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক আদালত বা শান্তি মিশনের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করবে। এটি সামরিক শক্তির ব্যবহার এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান করার পথ তৈরি করে।
প্রখ্যাত উদাহরণ:
- জাতিসংঘ: জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা বাহিনী এবং এর সদস্য রাষ্ট্রদের মধ্যে সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছে। জাতিসংঘের শরণার্থীদের সুরক্ষা, যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা, এবং নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তসমূহ সমষ্টিগত নিরাপত্তার উদ্দেশ্য পূরণ করে।
- লিগ অব নেশনস: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, সমষ্টিগত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য লিগ অব নেশনস (League of Nations) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যদিও এটি পুরোপুরি সফল হয়নি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমষ্টিগত নিরাপত্তার সুবিধা:
- শান্তি বজায় রাখা: এটি যুদ্ধের সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে, কারণ আক্রমণকারী রাষ্ট্র জানে যে, তার বিরুদ্ধে পুরো পৃথিবী সম্মিলিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
- বিশ্বজুড়ে স্থিতিশীলতা: প্রতিটি রাষ্ট্র একে অপরকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্বে থাকলে, বিশ্বব্যাপী শান্তির পরিবেশ তৈরি হয়।
সমষ্টিগত নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ:
- রাষ্ট্রগুলির স্বার্থের বিরোধিতা: রাষ্ট্রগুলির মধ্যে স্বার্থের অমিল হলে সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে না। কখনও কখনও একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে সংঘর্ষে পড়তে পারে।
- বিশ্বের প্রধান শক্তির বিরোধ: বড় শক্তির মধ্যে সংঘাত হলে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বা রাশিয়ার মধ্যে, তখন সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন বৃহৎ শক্তি নিজেদের স্বার্থের জন্য সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করতে পারে।
উপসংহার:
সমষ্টিগত নিরাপত্তা একটি শক্তিশালী নীতি, যা রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শান্তি এবং নিরাপত্তা বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। তবে, এর কার্যকারিতা রাষ্ট্রগুলির আন্তরিকতা, সহযোগিতা, এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধার ওপর নির্ভর করে। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এ ধরনের ব্যবস্থাকে প্রয়োগে সহায়তা করে, তবে কখনও কখনও জাতীয় স্বার্থের অমিল বা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এর সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।