মসাময়িক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবেশগত কারণগুলির ভূমিকা–
পরিবেশগত কারণগুলি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, বিশেষত বর্তমান বিশ্বে যেখানে পরিবেশগত পরিবর্তন, জলবায়ু সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং টেকসই উন্নয়ন নতুন আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি, শক্তির ভারসাম্য, এবং গ্লোবাল কোঅপারেশনকে প্রভাবিত করছে। পরিবেশগত কারণগুলির মূল ভূমিকা নিম্নরূপ:
১. জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change):
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: জলবায়ু পরিবর্তন আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি প্রধান দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার সমাধান একক রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সংস্থাগুলি যেমন প্যারিস চুক্তি (2015) রাষ্ট্রগুলিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা সীমিত করতে একত্রিত করেছে।
- পরিবেশগত শরণার্থী: জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে কিছু অঞ্চলে মানুষ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, যার ফলে পরিবেশগত শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর চাপ সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রগুলির অভিবাসন নীতি ও সীমান্ত ব্যবস্থায়।
২. প্রাকৃতিক সম্পদ (Natural Resources):
- সম্পদ সংকট: পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের সীমিততা এবং সেগুলির প্রতি প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। যেমন, তেল, গ্যাস, পানি এবং খনিজ সম্পদের জন্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১১ সালে লিবিয়ায় সংঘর্ষের একটি অংশ ছিল তেলের দখল নিয়ে প্রতিযোগিতা।
- সাম্প্রতিক সংঘাত: আফ্রিকার কিছু দেশ, যেমন সুদান, দক্ষিণ সুদান, এবং কঙ্গো, প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে, যার প্রভাব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও শান্তিরক্ষা অভিযানে পড়ছে।
৩. পরিবেশগত অবকাঠামো ও টেকসই উন্নয়ন (Environmental Infrastructure and Sustainable Development):
- বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন কৌশল: বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনের জন্য পরিবেশগত সহনশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতা ও অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন, যাতে পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা যায়।
- তৈল ও গ্যাস সম্পর্কিত পরিবেশগত সমস্যা: বিশ্বব্যাপী শক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পেলে, অপরিশোধিত তেল এবং গ্যাস খনি খনন করতে গিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে, যেমন অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম কোম্পানির ২০১০ সালের বৃহত্তম তেল ছড়ানোর ঘটনা (Deepwater Horizon Oil Spill)।
৪. জলবায়ু সাম্যতা ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা (Climate Justice and Global Security):
- বিপর্যয় ও সুরক্ষা: জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে কিছু অঞ্চলে মানবিক সংকট তৈরি হচ্ছে। যেমন, সাইক্লোন, বন্যা, খরা, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ রাষ্ট্রগুলির নিরাপত্তা সমস্যায় পরিণত হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করছে।
- পরিবেশগত নিরাপত্তা: পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে রাষ্ট্রগুলির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যেমন খাবারের সংকট, পানির অভাব, অথবা সংঘর্ষের কারণে বিপুল সংখ্যক অভ্যন্তরীণ শরণার্থী তৈরি হওয়া। এর ফলে রাষ্ট্রগুলি একে অপরের সাহায্য নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বাড়ানোর চেষ্টা করে।
৫. পরিবেশগত নীতির পারস্পরিক প্রভাব (Cross-border Environmental Policies):
- পানি ও দূষণ: নদী, সাগর এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়ের দূষণ ও বণ্টন নিয়ে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সংঘাত হতে পারে। যেমন, গঙ্গা, মেকং বা নীল নদীর মতো আন্তর্জাতিক নদীগুলির পানির ব্যবহারের ওপর বিভিন্ন দেশের সমঝোতা এবং বিতর্ক থাকে।
- বায়ু দূষণ: বৈশ্বিক বায়ু দূষণ ও গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলির মধ্যে একটি। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবেশগত নীতি নির্ধারণে অংশীদারিত্ব এবং সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
৬. বৈশ্বিক পরিবেশগত আন্দোলন (Global Environmental Movements):
- পরিবেশবাদী সংগঠন: আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থাগুলি, যেমন গ্রিনপিস, বিশ্ব প্রকৃতি তহবিল (WWF), এবং অন্যান্য সংগঠনগুলি রাষ্ট্রগুলির পরিবেশ নীতির ওপর চাপ তৈরি করছে। এটি সরকারগুলিকে পরিবেশ রক্ষার নীতি গ্রহণ করতে প্রভাবিত করছে, যেমন পুনঃবিক্রয়যোগ্য শক্তি উৎসের প্রচার।
- পিপলস মুভমেন্টস: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনগণ ও নাগরিক সমাজ পরিবেশগত ন্যায়বিচার ও পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করছে। এর মাধ্যমে পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেশগুলির রাজনৈতিক চাপ এবং নীতির পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে।
উপসংহার:
পরিবেশগত কারণগুলো আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, এবং পরিবেশগত বিপর্যয় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সংঘর্ষ উভয়ই সৃষ্টি করতে পারে। সমাধান প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক সংস্থা, বহুপাক্ষিক চুক্তি, এবং রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে, তবে এটি বাস্তবায়ন করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।