সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রীর মত
শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ সংস্কারের অন্যতম অগ্রদূত। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এবং সামাজিক কর্মে নারীর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ *‘আত্মচরিত’*তে নারীর সামাজিক অবস্থান ও তাঁরা যে অবহেলিত অবস্থায় ছিলেন, সে সম্পর্কে তাঁর তীব্র মনোভাব এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। শিবনাথের মতে, নারীদের সমাজে এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, তবে ঐতিহাসিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত নিচু, যেখানে তাঁদের মানবাধিকার, শিক্ষা ও মর্যাদা প্রায়শই উপেক্ষিত হত।
এ লেখায় আমরা ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থের আলোকে শিবনাথ শাস্ত্রীর নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর সমাজসংস্কারক চিন্তা-ধারা নিয়ে আলোচনা করব।
১. নারীর সামাজিক অবস্থান এবং শিবনাথের দৃষ্টিভঙ্গি
শিবনাথ শাস্ত্রী এমন এক যুগে জন্মগ্রহণ করেন, যখন নারী সমাজের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি এবং কুসংস্কারের আধিক্য ছিল। নারীরা তখন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপেক্ষিত ছিল—তাঁদের শিক্ষা, কর্ম, অধিকার ও মর্যাদা প্রায়শই আক্রমণাত্মক ছিল। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে শিবনাথ শাস্ত্রী নারীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন।
- *‘আত্মচরিত’*তে তিনি একাধিক জায়গায় নারীদের অবস্থান নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে মনে করতেন যে, নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পেলে পুরো সমাজের উন্নতি সম্ভব।
নারীকে নীচু দৃষ্টিতে দেখা এবং তাকে শুধুমাত্র গৃহকর্ম এবং গর্ভধারণের যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা সমাজের একটি বড় সমস্যা ছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী বিশ্বাস করতেন যে, নারীদের মানুষের মতো সম্মান দিয়ে তাদের সমান অধিকার দেওয়া উচিত, এবং তারা পুরুষদের সঙ্গে সমান সুযোগ পাওয়ার যোগ্য।
২. নারীর শিক্ষা এবং সচেতনতা
শিবনাথ শাস্ত্রী নারীদের শিক্ষা নিয়ে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন এবং তাঁকে শিক্ষিত করা সমাজের দায়িত্ব বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, নারীর শিক্ষা শুধুমাত্র তাদের আত্মনির্ভরশীলতার জন্য নয়, বরং সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- *‘আত্মচরিত’*তে শিবনাথ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীর শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি নিজেও নারীশিক্ষার গুরুত্ব বুঝতেন। নারীদের শিক্ষিত করার মাধ্যমে সমাজে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন।
- তিনি মনে করতেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা শিক্ষিত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়।“
নারীর শিক্ষার ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত অগ্রসর। তাঁর মতে, শিক্ষিত নারী সমাজের সম্পদ, যা ভবিষ্যতে সমাজে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তাই তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের শিক্ষার প্রসারে নিরলস কাজ করতেন।
৩. নারী ও বৈবাহিক জীবনের সম্পর্ক
শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে বৈবাহিক জীবনের সম্পর্কেও নারীকে সমান অংশীদার হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, বৈবাহিক জীবন একটি পারস্পরিক সমঝোতা এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠা উচিত, যেখানে নারীরও সমান অধিকার রয়েছে। তিনি নারীর স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ব দিতেন, যা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান এবং সমর্থন তৈরি করতে সাহায্য করত।
- তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, “বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে নারীর অধিকারকে উপেক্ষা করা উচিত নয়, বরং তাকে সমান মর্যাদা দিতে হবে।“
- শিবনাথ তাঁর স্ত্রীকে সর্বদা সম্মান এবং মূল্যায়ন করতেন, যা সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ভাবনার বিরোধিতা করেছিল।
এই দৃষ্টিভঙ্গি শিবনাথের সমাজসংস্কারক চিন্তার একটি প্রধান দিক ছিল এবং তাঁর জীবনে এটি প্রতিফলিত হয়েছিল।
৪. সমাজে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন
শিবনাথ শাস্ত্রী বিশ্বাস করতেন যে নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। নারীদের শুধুমাত্র শারীরিক দিক থেকে নয়, বরং মনের দিক থেকেও সমৃদ্ধ করতে হবে। তিনি জানতেন, নারীদের উন্নতির ফলে শুধুমাত্র তাদের জীবনযাত্রা উন্নত হবে না, বরং সমগ্র সমাজের মানসিকতা ও চিন্তা-ধারা পাল্টে যাবে।
- শিবনাথ তাঁর পিতামহী এবং পরিবারের অন্যান্য নারীদের উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং তাদেরকে সমাজের উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন।
- তিনি মনে করতেন, নারীদের উন্নতির জন্য তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতা প্রয়োজন, এবং সমাজকে অবশ্যই এই পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
তাঁর মতে, নারীদের স্বাধীনতা না দিলে সমাজের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।
৫. নারী ও ধর্মের সম্পর্ক
শিবনাথ শাস্ত্রী ধর্মীয় ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান সম্পর্কেও নিজের মতামত দিয়েছেন। তিনি দেখতেন যে, পুরনো ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি নারীদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণকে সমর্থন করে। এ বিষয়ে তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মের ক্ষেত্রে নারীর শ্রী ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে এবং কোনভাবেই তাঁদের অধিকার খর্ব করা উচিত নয়।
- *‘আত্মচরিত’*তে শিবনাথ শাস্ত্রী এমন কিছু ধর্মীয় অনুশাসনের বিরোধিতা করেছেন, যা নারীদের অবমাননা বা তাদের অধিকারহীন করে তুলেছিল। তিনি বলেছিলেন, “ধর্মের মধ্যে নারীকে দৃষ্টিহীন বা অধিকারহীনভাবে উপস্থাপন করা উচিত নয়।“
শিবনাথ বিশ্বাস করতেন যে, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোর সংস্কার করা প্রয়োজন।
৬. নারীর আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাস
শিবনাথ শাস্ত্রী নারীকে শুধু শিক্ষিত বা মুক্তি লাভের উপায় হিসেবেই নয়, বরং তাদের আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন। তিনি জানতেন, যদি নারীরা নিজের মর্যাদা বুঝতে পারে এবং নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করে, তবে তারা সমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
- তাঁর মতে, “নারীর প্রকৃত শক্তি তার আত্মবিশ্বাসে নিহিত।“
- তিনি নারীকে শুধুমাত্র সংসারের সেবিকা হিসেবে নয়, বরং সমাজের পরিবর্তনশীল শক্তি হিসেবে দেখতেন।
উপসংহার
শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর জীবন এবং চিন্তাভাবনায় নারীকে যথার্থ মর্যাদা এবং সম্মান প্রদানের জন্য বরাবরই সচেষ্ট ছিলেন। *‘আত্মচরিত’*তে নারীর অধিকার, মর্যাদা, শিক্ষা এবং আত্মনির্ভরশীলতার বিষয়ে তাঁর মতামত স্পষ্ট। তাঁর মতে, নারীর স্বাধীনতা ও উন্নতির জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের সংস্কার প্রয়োজন। শিবনাথ শাস্ত্রী বিশ্বাস করতেন, নারীদের ক্ষমতায়ন ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হলে তবেই সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন আসবে। তাঁর চিন্তা এবং কার্যকলাপ এই সমাজের নারীসমাজের প্রতি সহানুভূতির উদাহরণ হয়ে আজও অমূল্য।