সমাজ ও সাহিত্যে তুর্কি বিজয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা কর।

বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে আনুমানিক ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিরা বাংলাদেশ অভিযান করে এবং সফলও হয়। বাংলাদেশের সমাজজীবনে এই তুর্কি-বিজয়ের নানা প্রভাব লক্ষ করা যায়-

বর্গসম্মিলন: তুর্কি-বিজয়ের ফলে বর্ণহিন্দুরা আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে এতদিনকার অস্পৃশ্য অনার্য জাতিগােষ্ঠীগুলির সঙ্গে সংযােগ তৈরি করে। ফলে মনসা, চণ্ডীর মতাে অনার্য দেবীরা ব্রাত্মণ্যতন্ত্রে প্রবেশাধিকার পান।

সাংস্কৃতিক প্রতিরােধ: বহিরাগত শক্তিকে প্রতিরােধের জন্য যে ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিরােধ তৈরি করা হয় তার অংশ হিসেবে অনার্য দেবীরা যেমন বর্ণহিন্দুদের পুজো লাভ করতে শুরু করেন, সেভাবেই উচ্চবর্ণের পূজ্য পৌরাণিক দেবদেবীরাও নিম্নশ্রেণির লােকেদের দ্বারা পূজিত হতে শুরু করলেন।

সমাজ-সংস্কৃতির নতুন প্রেক্ষাপট: সাময়িক অনিশ্চয়তার অবসানে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির সূত্র ধরে তৈরি হয় সমাজ-সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট। রুকনউদ্দিন বরবক্ শাহ্ ভাগবতের অনুবাদে পৃষ্ঠপােষকতা করেন। গৌড় মল্লিকের পৌরােহিত্যে হুসেন শাহ এই মিশ্র সংস্কৃতিকে শিখরে পৌঁছে দেন। পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপােষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের যে অনুবাদ করেছিলেন, সেখানেও হুসেন শাহ্ এবং তাঁর পুত্র নসরৎ শাহের বিশেষ অবদান ছিল। নিম্নবর্গীয়দের লােকায়ত ধর্ম হিসেবে নাথ ধর্মের আবির্ভাব, ধর্মঠাকুর, সত্যপির প্রভৃতি দেবতার উদ্ভব উভয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায়। ভক্তি ধর্ম ও সুফি ধর্মের মিলনও বাংলাদেশে তুর্কি-আক্রমণের একটি সদর্থক ফল।

এইভাবেই তুর্কি-আক্রমণ ও তুর্কি-বিজয় বাংলাদেশের সমাজজীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

তুর্কি-আক্রমণ বাংলা সাহিত্যে কী প্রভাব ফেলেছিল‌ আলােচনা করাে:-

তুর্কি-আক্রমণের ফলে বাংলার সমাজজীবনে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তা সাহিত্যসৃষ্টির পক্ষে অনুকূল ছিল না। কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল যথেষ্টই।

বর্গসম্মিলনের সূত্র ধরে অনার্য দেবদেবীদের আর্যীকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, তার ফলেই সৃষ্টি হয় মঙ্গলকাব্যগুলির। লৌকিক পরিমণ্ডলে মনসা, চণ্ডী ইত্যাদি দেবদেবীর যেসব বন্দনাগান প্রচলিত ছিল, সেগুলি লিখিত রূপ হিসেবে স্থান পায় বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে।

সাধারণ মানুষ পৌরাণিক দেবদেবীদের পূজা-অর্চনার অধিকার পাওয়ায় সূচনা হয় অনুবাদ সাহিত্যের। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এইসব দেবতাদের মাহাত্মের সঙ্গে লােক-সাধারণের সরাসরি সংযােগসাধন। এভাবেই রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের অনুবাদে সমৃদ্ধ হয় বাংলা সাহিত্য।

তুর্কি-আক্রমণের ফলে সমাজ মানসিকতার যে বদল ঘটে, তার ফলে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পায় লৌকিকতা। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘আভীর’ কৃষ্ণ এই লৌকিকতারই ফসল। কৃত্তিবাসের বাঙালিয়ানাতেও আর-একভাবে আসে এই লৌকিকতা।

তুর্কি-আক্রমণের ফলে হিন্দু রক্ষণশীলতার দুর্গে ফাটল ধরে, আর এই মিশ্র সংস্কৃতির পথ ধরেই ঘটে চৈতন্যের আগমন। আবার এই পথেই সুফি ধর্মের যে বিকাশ ঘটে, তা বাংলা সাহিত্যে বাউল ভাবধারার জন্ম দেয়।

এভাবেই তুর্কি-আক্রমণ আপাতভাবে নিষ্ফলা হলেও বাংলা সাহিত্যে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সমর্থ হয়।

মধ্যযুগের বাংলার সমাজজীবনের পরিচয় দাও

তুর্কি আক্রমণের পরে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ইলিয়াস শাহি বংশের শাসনের সূচনা ঘটালে গৌড়বঙ্গে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসে। দীর্ঘকাল পর গৌড়বঙ্গের সিংহাসনে সম্রাট হুসেন শাহ অধিষ্ঠিত হলে (১৪৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হয়।

তুর্কি-বিজয় বর্ণহিন্দুদের অপ্রতিহত সামাজিক আধিপত্যকে নষ্ট করে দেয়। আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে এতদিনকার অস্পৃশ্য অনার্য জাতিগােষ্ঠীগুলির সঙ্গে তাই আর্য বর্ণহিন্দুরা সংযােগ তৈরি করতে বাধ্য হয়। এর ফলে মনসা, চণ্ডীর মতাে অনার্য দেবতা ব্রায়মণ্যতন্ত্রে প্রবেশাধিকার পান এবং বর্ণহিন্দুদের দ্বারা পূজিত হতে শুরু করেন। উলটো দিকে বর্ণহিন্দুদের আরাধ্য দেবদেরীরাও লােকচরিত্র লাভ করেন। হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতির মিলনের চিহ্ন হিসেবে সত্যপির প্রভৃতি দেবতার উদ্ভব ঘটে।

মুসলিম বিজয় বাংলা দেশে শুধু সামাজিক ও ধর্মীয় ঐক্যই ঘটায় না, সংস্কৃতির মেলবন্ধনও ঘটায়। রুকনউদ্দিন বরবক্ শাহ ভাগবতের অনুবাদে যেমন পৃষ্ঠপােষকতা করেন, তেমনি গৌড় মল্লিকের পৌরােহিত্যে হুসেন শাহ এই মিশ্র সংস্কৃতিকে উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছে দেন। এই সম্প্রীতির পথ ধরে ভাগবতসহ রামায়ণ মহাভারত বাংলা ভাষায় কাব্যরূপে অনূদিত হয়।

এই সময়েই চৈতন্যের আবির্ভাব জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি সমস্তরকমের বিভেদের মূলে আঘাত দেয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading