1905 সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বাংলাকে প্রশাসনিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না-দেওয়া। কিন্তু আন্দোলনের ব্যাপকতা ও গভীরতা অচিরেই একে স্বদেশের মুক্তি আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য স্তরে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি জনজাগরণ ও সামাজিক বিবর্তনের ধারার সূত্রপাত হয়। স্বদেশি আন্দোলনের মূল আবেগে ধর্মীয় ও সামাজিক শ্রেণিচেতনায় বিভক্ত দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই’ ধ্বনির পাশে অন্ত্যজ শ্রেণির লোকেদেরও মানবিক অধিকারবোধে সঞ্জীবিত করা এবং তাদের জাতীয় মূলস্রোতে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ করা যায়। এই চেষ্টারই একটি বলিষ্ঠ স্বরূপ প্রকাশ পায় সাঁওতালদের দিনাজপুর ও মালদা জেলায় স্বরাজ আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা কাশীশ্বর চক্রবর্তীর প্রেরণাপুষ্ট সাঁওতাল বিদ্রোহে। এখনকার সাঁওতাল বিদ্রোহ আসলে ছিল তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণের প্রকাশ্য ঘোষণা।
মালদা জেলার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বিপুল সংখ্যক সাঁওতালি আদিবাসী সামাজিক অবহেলা ও অর্থনৈতিক অবিচারের মধ্যে পড়েছিল। 1926 সালে এই তথাকথিত অস্ত্যজ শ্রেণির লোক হিন্দুসমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে সমমর্যাদায় যুক্ত হতে চেয়েছিল। প্রশাসনিক সমস্যা শুরু হয় যখন তারা দাবি করে ‘কালীপূজা’ করার অধিকার নিয়ে। মালদার বুকে অন্ত্যজ শ্রেণির নিজস্ব ‘কালীপুজো’র উদ্যোগে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ আপত্তি তোলে। জেলাশাসক 144 ধারা জারি করে পুজো বন্ধ করে দেয় এবং কাশীশ্বর চক্রবর্তীকে জেলা থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু সাঁওতালদের সামাজিক অধিকারের আন্দোলন থামে না। ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে সরকারিভাবে তাদের দাবি মেনে নিতে হয় এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে ব্যাপক পুলিশি ব্যবস্থা করে সরকারকে কালীপূজার অনুমতি দিতে হয়। প্রায় তিন হাজার সাঁওতাল এই পূজায় যোগ দেয়।
গণ-আন্দোলনের মুখে পড়ে ব্রিটিশ প্রশাসন সাঁওতালদের দাবি মানতে বাধ্য হয় বটে কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এটিকে সুনজরে দেখে না। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য যেমন তারা সুনজরে দেখেনি, তেমনি উচ্চবর্ণ হিন্দুর সঙ্গে অন্ত্যজ শ্রেণির সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যেরও তারা ছিল বিরোধী। তাই সাঁওতালদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণের চেষ্টাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে তাদের নেতা জিতু সাঁওতাল ও অর্জুন সাঁওতালকে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে ফেলে। জিতু সাঁওতালকে সেভাবে দমন করা যায় না। সে প্রকাশ্যে ব্রিটিশ বিরোধিতা শুরু করে। তার নেতৃত্বে সাঁওতাল পল্লিগুলিতে ব্যাপক জমায়েত হতে শুরু করে। প্রকাশ্য সমাবেশগুলিতে ব্রিটিশ সরকারের অবসান যে আসন্ন সে তা প্রচার করতে লাগল। গরিব সাঁওতালগণ জিতুকে তাদের নেতা বলে মেনে নেয়। তার হাতে তুলে দিল আন্দোলনের অর্থ এবং জিতু সাঁওতাল ব্রিটিশ আইন ও শাসন না-মেনে আন্দোলন গড়ে তুলতে লাগল। সৃষ্টি হয় ব্রিটিশশক্তির সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘাতের পরিবেশ।
খেতমজুর শ্রেণি সাঁওতালদের এই রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি প্রধানত, মালদার জোতদার শ্রেণির মুসলমানরা সুনজরে দেখে না। সাঁওতালদের রাজনৈতিক বিকাশ যারা চাইছিল না, তারা সেই সুযোগে সাঁওতাল ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি করে। ভূমিপ্রধান মুসলমান সমাজের অত্যাচারে সাঁওতাল সমাজও অচিরেই মুসলিম-বিরোধী হয়ে উঠে। এই সময় কাশীশ্বরবাবু জেলার বাইরে ছিলেন। সাঁওতাল আন্দোলন হয়ে যায় অনিয়ন্ত্রিত। এই পরিস্থিতিতে সাঁওতালদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় অধিকারের দাবি, মুসলিম-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। জিতুর নিয়ন্ত্রণে হাজার হাজার সাঁওতাল আদিনা মসজিদের দখল নেয় এবং সেটিকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করে। হাজার হাজার দরিদ্র সাঁওতালের যোগ্য উপাসনার মন্দির দরকার। জেলা প্রশাসন এই ঘটনার পূর্ণ সুযোগ নেয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপরাধে আদিনা মসজিদ প্রাঙ্গণেই সশস্ত্র পুলিশ সাঁওতালদের ওপর গুলি চালায়। সাঁওতালরাও তিরধনুক নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করে। মুখোমুখি সশস্ত্র লড়াইয়ে পুলিশ ও সরকার পক্ষের অনেকে আহত হয় এবং একজন কনস্টেবল তিরবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। কিন্তু বন্দুকের গুলির সামনে তিরধনুক নিয়ে সাঁওতালরা বেশিক্ষণ টিকতে পারে না, বহু সাঁওতাল আহত হয় এবং ঘটনাস্থলেই তিনজন সাঁওতালের মৃত্যু হলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এই ঘটনার পরে সাঁওতাল পল্লিগুলিতে ব্যাপক ধরপাকড়, হয়রানি, জরিমানা ও জেল-হাজত চলতে থাকে এবং মালদার সাঁওতাল আন্দোলন তখনকার মতো স্তিমিত হয়ে পড়ে।
কিছুদিনের মধ্যে (1900) দিনাজপুর জেলার সাঁওতালগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। বালুরঘাট জেলায় তারা আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হয়। সাঁওতলাদের মধ্যে ‘খাজনা’ না-দেওয়ার আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। বিভিন্ন স্থানে ‘চৌকিদারি-ট্যাক্স’ সংগ্রহও সম্ভবপর হয় না। 1930 সালের অক্টোবর মাসে পতিরাজ অঞ্চলে সশস্ত্র সাঁওতালদের বড়ো বড়ো মিছিল এসে চৌকিদারি ট্যাক্স আদায় বন্ধ করে দেয়। কিছু কিছু স্থানে বন্দি আসামীকে থানায় নিয়ে আসতে গিয়ে পুলিশ সাঁওতালদের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়। 1932 সালের জুন-জুলাই মাসে আকচা অঞ্চলের সাঁওতালরা ব্রিটিশ সরকারকে সবরকম ‘কর’ দানে বিরত থাকে। অনিবার্যভাবেই ব্রিটিশ সরকার দমননীতির আশ্রয় নেয়। ফলে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে সাঁওতালদের পুনরায় সংঘর্ষ বাধে। বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে প্রায়ই ছোটো- বড়ো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে। গুলিও চলে বহু জায়গায়। এই জেলাতেও ব্যাপক ধরপাকড়, পুলিশি নির্যাতন চলে এবং শত শত সাঁওতালকে জেলে পুরে এই আন্দোলন চুরমার করা হয়। তথাপি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিবাদের যে সংগ্রামী দৃষ্টান্ত দরিদ্র সাঁওতালরা সেদিন দেখিয়েছিল, তা উত্তরবঙ্গের স্বরাজ-আন্দোলন ও প্রজাবিদ্রোহের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।