সামাজিক চুক্তি সম্পর্কে লকের ধারণা-
জন লক (John Locke) ছিলেন ইংরেজ দার্শনিক এবং রাজনৈতিক তত্ত্বজ্ঞ, যিনি আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সামাজিক চুক্তি (Social Contract) তত্ত্ব, যা মূলত তাঁর “Two Treatises of Government” (1689) গ্রন্থে বর্ণিত, তা রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা প্রদান করে। লক তাঁর তত্ত্বে মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থান, স্বাধীনতা, এবং অধিকারকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সরকারের গঠন এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমানা নির্ধারণ করেছেন।
লকের সামাজিক চুক্তি :
১. প্রাকৃতিক অবস্থা
লক তাঁর তত্ত্বে প্রথমে প্রাকৃতিক অবস্থার কথা বলেন। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ স্বাধীন এবং সমান, এবং তাদের মধ্যে কোনো রাজনীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু এই স্বাধীনতার সঙ্গে কিছু সমস্যা ছিল, যেমন ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত বিচারব্যবস্থা না থাকা এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাসের অভাব। এই সমস্যাগুলির সমাধান হিসেবে সামাজিক চুক্তির ধারণা এসেছে।
২. প্রাকৃতিক অধিকার
লক মানবাধিকারের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রত্যেক ব্যক্তি তিনটি মৌলিক প্রাকৃতিক অধিকার ভোগ করেন: জীবন (Life), স্বাধীনতা (Liberty), এবং সম্পত্তি (Property)। এই অধিকারগুলি প্রাকৃতিক অবস্থায় সকল মানুষের জন্য স্বীকৃত, এবং এগুলির কোনো ধরনের লঙ্ঘন সামাজিক চুক্তির আওতায় গণ্য করা হয়।
৩. সামাজিক চুক্তি
লক বলেছিলেন যে, সমাজে শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ একে অপরের সাথে একটি চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুসারে, তারা নিজেদের প্রাকৃতিক অধিকার (জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তি) রক্ষার জন্য একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করে। সরকার এই অধিকারগুলো সুরক্ষিত রাখতে দায়িত্ববান এবং জনগণের সম্মতি বা অনুমতি অনুযায়ী কাজ করবে।
৪. সরকারের সীমাবদ্ধতা
লক বিশ্বাস করতেন যে, সরকারের ক্ষমতা সীমিত এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষা করা তার প্রধান কর্তব্য। সরকারকে জনগণের সম্মতি এবং অধিকার রক্ষা করতে হবে; অন্যথায়, জনগণ সরকারকে উৎখাত করার অধিকার রাখে। এটি “অধিকার বা শাসকশক্তির সীমাবদ্ধতা” (Limited Government) এবং জনগণের অভিপ্রায় (Popular Sovereignty)-এর ধারণার প্রতি লকের অঙ্গীকার।
৫. রাজনৈতিক বিদ্রোহের অধিকার
লক আরও বলেছিলেন যে, যদি কোনো সরকার তার কর্তব্য পালন করতে ব্যর্থ হয় বা জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে জনগণ সেই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার রাখে। এ ধারণাটি পরবর্তীতে বিপ্লবী আন্দোলনগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করেছে।