ভূমিকা : –
একটি আধুনিক রাষ্ট্র হল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। সার্বভৌমিকতা একটি রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। একটি দেশ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী না হলে তাকে রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রকে অন্যান্য সামাজিক রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠান থেকে একটি পৃথক রাষ্ট্র হওয়ার অধিকার দেয়। গেটেলের মতে, সার্বভৌমিকতা ধারণাটি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি। মিলার যেমন উল্লেখ করেছেন, আমাদের অবশ্যই সার্বভৌম রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক জীবনের প্রাথমিক বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
সার্বভৌমিকতা বলতে কী বোঝো ?
সার্বভৌমিকতা সংজ্ঞা :- বস্তুতপক্ষে সার্বভৌমিকতার আলোচনা ব্যতীত আধুনিক রাষ্ট্রের ভূমিকা ও তার সর্বব্যাপক ক্ষমতার অনুধাবন সম্ভব নয়। ‘সভ্নেটি’ (Sovereignty) শব্দটি লাতিন শব্দ ‘সুপ্রিমাস’ (Supremus) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘সুপ্রিমাস’ শব্দের অর্থ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ বা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত বা সর্বোচ্চ ক্ষমতার ধারণা ব্যক্ত করার জন্য এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন এবং আদেশ জারির মাধ্যমে ঐ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সার্বভৌমিকতা বলতে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ, সর্বোচ্চ ও অবাধ ক্ষমতাকে বোঝায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বোঁদার মতে, আইন দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত নাগরিক ও জনগণের ওপর রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতাকে সার্বভৌম ক্ষমতা বলে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেসের মতে, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সমস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্রের মৌলিক ও সীমাহীন ক্ষমতাকে সার্বভৌমিকতা বলে। সংক্ষেপে সার্বভৌমিকতা হলো সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্রের আইনগত চরম ও অবাধ ক্ষমতা।
সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা :
অস্টিনের সার্বভৌমিকতা তত্ত্ব : – বিখ্যাত আইনবিদ জন অস্টিন 1832 : Lectures on Jurisprudence: The Philosophy of Positive Law বইটিতে তিনি তার সার্বভৌমত্বের মতবাদ প্রচার করেছেন। এই বিষয়ে, তিনি চুক্তিবাদী হোস এবং উপযোগবাদী ব্যোমের সার্বভৌমত্ব
তত্ত্বকে একত্রিত করে আইনি সার্বভৌমত্বের একটি তত্ত্ব তৈরি করেন।
অস্টিন প্রদত্ত সংজ্ঞা : –সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জন অস্টিন বলেন, “যখন কোনো সমাজের কোনো বিশেষ উচ্চতর কর্তৃপক্ষ অন্য কোনো অনুরূপ কর্তৃপক্ষের আনুগত্য স্বীকার না করে সেই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বাভাবিক আনুগত্য উপভোগ করে, তখন সেই বিশেষ উচ্চতর কর্তৃপক্ষ (ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদ) সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। সেই সমাজে এবং সেই সমাজ, সেই কর্তৃত্ব সহ, একটি রাজনৈতিক ও স্বাধীন সমাজ।” তিনি আইনকে অধস্তনদের উচ্চতর কর্তৃত্বের আদেশ বলে বর্ণনা করেছেন। যেহেতু এই ধরনের আদেশগুলি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অসীম ক্ষমতা দ্বারা সমর্থিত, অধস্তনরা সেই আদেশগুলি উপেক্ষা বা অমান্য করার সাহস করে না।
সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী বৈশিষ্ট্য : –
A) কেবলমাত্র রাজনৈতিক ও স্বাধীন সমাজেই সার্বভৌমিকতার অস্তিত্ব থাকে।
B) এরূপ সমাজে সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদ। সুতরাং সার্বভৌমিকতার অবস্থান সম্পর্কে কোনো বিরোধ থাকার কথা নয়, কারণ প্রকৃতিগতভাবেই তা সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট। এরূপ সার্বভৌম শক্তি জনসাধারণের মতো অনির্দিষ্ট কিংবা সাধারণ ইচ্ছা (General Will)-এর মতো নৈর্ব্যক্তিক (Impersonal) নয়।
C) সার্বভৌম শক্তি হলো এমন একটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা অন্য কোনো অনুরূপ কর্তৃপক্ষের নিকট আনুগত্য প্রদর্শন করে না, অর্থাৎ সার্বভৌম ক্ষমতা চরম ও অসীম।
D) অস্টিনের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রকৃতিগতভাবে চরম ও অসীম ক্ষমতার অধিকারী বলে রাষ্ট্রাধীন সব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সঙ্ঘের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে। এরূপ সার্বভৌম কর্তৃত্ব সর্বব্যাপী বলে তা অবিভাজ্য অর্থাৎ তাকে বিভক্ত করা যায় না।
E) জনগণ স্বভাবজাতভাবেই সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্য প্রদর্শন করে। সুতরাং জনগণের স্বাভাবিক আনুগত্যকে সার্বভৌমিকতার মানদণ্ড বলে মনে করা হয়। সার্বভৌম শক্তির প্রতি জনগণের আনুগত্য অস্থায়ী বা সাময়িক নয়, স্বভাবজাত বলেই এরূপ আনুগত্য মোটামুটি স্থায়ী প্রকৃতিসম্পন্ন হয়।
অস্টিনের তত্ত্বের তাৎপর্য : –
অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, অস্টিনের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের তিনটি তাৎপর্য রয়েছে, যথা –
A) অস্টিনের মতে, রাষ্ট্র হলো আইন অনুসারে সংগঠিত এমন একটি সংস্থা (a legal order) যেখানে নির্দিষ্ট কর্তৃত্বই হলো সমগ্র ক্ষমতার উৎস।
B) এরূপ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব (state power) অসীম অর্থাৎ কোনো কিছুর দ্বারা সীমাবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত নয়। ও সার্বভৌম শক্তির আদেশই হলো আইন।
C) আইনভঙ্গের অপরাধে রাষ্ট্র আইনভঙ্গকারীদের যথোচিত শাস্তি দিতে পারে।
একত্ববাদীদের বিরুদ্ধে বহুত্ববাদীদের সমালোচনার সীমাবদ্ধতা :
গণতান্ত্রিক আদর্শবিরোধী : – অস্টিনের সার্বভৌমত্ব জনগণের ইচ্ছা বা অধিকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্যুত। সার্বভৌমের ইচ্ছাপ্রসূত পীড়নমূলক আইন গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। বর্তমানে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রসারের সঙ্গে অস্টিনের ব্যাখ্যার গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে।
একত্ববাদের বিসর্জন : –ল্যাস্কি তীব্র ভাষায় রাষ্ট্রের একত্ববাদী তত্ত্বর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “It will be here argued that it would be of lasting benefit to political science if the whole concept of sovereignty were surrendered.” অর্থাৎ সমগ্র সার্বভৌমিকতা তত্ত্বটিকে বিসর্জন দিলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্থায়ী কল্যাণ সাধিত হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঘিরে। তাই তিনি সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বকে বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রের ইচ্ছা দায়িত্বহীন নয় : –
একত্ববাদে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার ওপরে কোনো দায়িত্ব বা শর্ত আরোপিত হয়নি। কিন্তু অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্রের ইচ্ছা কখনোই দায়িত্বহীন হতে পারে না। বস্তুত রাষ্ট্র বা সরকারের ইচ্ছা নাগরিকদের দ্বারা অনুমোদিত হওয়া প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রযোজ্য নয় : –
যুক্তরাষ্ট্রীয় তত্ত্বের ভিত্তিতেও অস্টিনের সার্বভৌমত্বের সমালোচনা করা হয়। অস্টিন যখন তাঁর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন তখনও আধুনিক রাষ্ট্র শৈশবাবস্থায় ছিল। সেই কারণে তাঁর ব্যাখ্যা এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রেরক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রযোজ্য নয়। অস্টিনের ধারণা অনুযায়ী কোনো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের সন্ধান যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায় না।
কেন্দ্রীভূত সর্বব্যাপী রাষ্ট্রের ধারণা গ্রহণযোগ্য নয় : –
একত্ববাদে যে কেন্দ্রীভূত সর্বব্যাপী রাষ্ট্রের ধারণাকে তুলে ধরা হয়েছে তা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। বার্কার সীমাহীন ও দায়িত্বহীন সর্বব্যাপী রাষ্ট্রের ধারণাকে মানবতার স্বার্থবিরোধী বলে অভিহিত করেছেন ।