সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

দয়ারাম সাহানি, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্যার জন মার্শাল প্রমুখ পুরাতাত্ত্বিকদের প্রচেষ্টায় হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা ‘সিন্ধু সভ্যতা’র উন্মেষ ঘটে ১৯২১ এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। অনুমান করা হয়, এই সভ্যতা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছরের পুরনো। বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের কিছু অঞ্চলের মধ্যে এই সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল। প্রায় ১২.৫ লক্ষ বর্গকিমি জায়গা জুড়ে সিন্ধু সভ্যতা তার বিস্তার ঘটিয়েছিল। এই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার কিছু প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি চোখে পড়ে। যেগুলি নিন্মে আলোচনা করা হল –

       উন্নত নগর পরিকল্পনাসিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতার প্রথম ও অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হল, এটি ছিল একটি “নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা”। এই সভ্যতার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, কালিবঙ্গান, চানহুদারো ইত্যাদি। এই কেন্দ্রগুলির সাথেই হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা তার বিকাশ ঘটিয়েছিল যা “উন্নত নগর পরিকল্পনার” শিরোপা বহন করে। নগরগুলির গঠন প্রণালী ছিল বর্তমানের যুগের মতোই। প্রতিটি নগর দুর্গ দ্বারা বেষ্টিত ছিল। প্রতিটি নগর দুটি অংশে বিভক্ত থাকত। একটি ছিল উচু অংশ এবং অপরটি নিচু অংশ। উচু অংশে তৈরি করা দুর্গে বসবাস করত এলাকার শাসক শ্রেণীর মানুষেরা। এলাকার সাধারন জনগণ দুর্গের নিচু অংশে ও নগরের মধ্যে বসবাস করত। 

        রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি – “সোজা ও চওড়া রাজপথ” ছিল সিন্ধু সভ্যতার একটি বিষয়। প্রতিটি বড়ো রাস্তার সঙ্গে যুক্ত থাকত ছোট ও সরু গলিপথ। গলিপথগুলি যুক্ত থাকত বড় রাজপথের সঙ্গে। এগুলি একে অপরের সঙ্গে সবসময় সমকোণে যুক্ত থাকত অর্থাৎ, ‘L’ বা ‘T’ আকৃতির ভাবে। রাজপথগুলি ছিল খুব চওড়া। প্রতিটি রাজপথ ৯ থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত হত। প্রতিটি রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ ভাবে বসবাসের ঘরগুলি নির্মিত হত। এইভাবে রাস্তার দুই ধারে রৈখিক জনবসতি গড়ে উঠত। সিন্ধু সভ্যতার ঘরগুলি ছিল একতলা, দোতলা ও তিনতলা বিশিষ্ট, যা এই সভ্যতার নগরকেন্দ্রিকতার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ঘরগুলি তৈরি করা হত পোড়া ও শুকনো ইট দিয়ে, যার মাপ হত ১ঃ২ঃ৪। প্রতিটি বাড়ি থাকত পাচিল দিয়ে ঘেরা। প্রতিটি বাড়িতেইথাকার ঘর, স্নানাগার, রান্নাঘর ও উঠোন প্রভৃতি থাকত । সিন্ধু সভ্যতার রাস্তাঘাট, বাড়িঘর সবকিছুই ছিল বর্তমান যুগের মত, তাই এই সভ্যতাকে নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা বলা যেতে পারে।


      পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাউন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। শহরের প্রতিটি বাড়ির জমা জল, নোংরা জল বাইরে বের করার জন্য প্রতিটি বাড়িতেই ছোট ছোট ড্রেন বা নালী থাকত। প্রতিটি বাড়ির নালী গুলি একে অপরের সাথে যুক্ত থাকত, এগুলির মাধ্যমে প্রতিটি বাড়ির নোংরা জল রাজপথের দু’ধারে তৈরি বড়ো প্রণালীতে এসে পড়ত। এরপর থেকে আরও বড় নালির মাধ্যমে নোংরা জল একেবারে শহরের বাইরে চলে যেত, এমন সুব্যবস্থা ছিল সিন্ধু সভ্যতায়।


          শস্যাগার   সিন্ধু সভ্যতার নগর গুলিতে সাধারণ মানুষের ব্যবহার করার জন্য কিছু স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল যার মধ্যে হরপ্পার শস্যাগারের কথাটি বলতেই হয়। শস্যাগারটির আয়তন ছিল ২০০ × ১৫০ বর্গফুট। শস্যাগারটির পাশে শস্য মাড়াই করার জায়গা ছিল। এখানে কর্মরত শ্রমিকরা শস্যাগারটির পাশে অবস্থিত ছোট ছোট বাড়িতে বসবাস করত।

স্নানাগার হরপ্পার পাশাপাশি মহেঞ্জোদারোতেও একটি  স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। যার আয়তন ছিল ১৮০ × ১০৮ ফুট। স্নানাগারটি তৈরি হয়েছিল পোড়া ইট দিয়ে এবং এর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, আধুনিক যুগের এটির নোংরা জল বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য সুব্যবস্থা ছিল। 


          ধর্মীয় জীবন সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা সাধারণত পশুপতি শিবের পূজা করত। তবে পাশাপাশি তারা মাতৃদেবতা এবং প্রকৃতির পূজাও করত। যেমন নদী, গাছ, পাথর প্রভৃতিরও পূজা এইসময় প্রচলিত ছিল। সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা ইহলোকের পাশাপাশি পরলোকেও বিশ্বাস করতেন। তারা মৃতদেহকে সমাধিস্থ করত। অনেক সময় মৃতদেহের পাশে মৃতের পছন্দের জিনিস বা তার ব্যবহার করা জিনিসপত্র রাখা হত।


খাদ্য ও পোশাক পরিচ্ছদ   সিন্ধু সভ্যতার শহরের অধিবাসীরা খুবই সৌখিনতার সাথে জীবনযাপন করত। তাদের খাদ্য তালিকায় খেজুর, বাদাম, গম, যব ইত্যাদি খাদ্য ছিল। তারা শূকরের মাংস এবং বিভিন্ন ধরনের পাখির মাংসও খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করত। সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত মূর্তি থেকে এই সভ্যতার মানুষের পোশাক পরিচ্ছদের ধারণা পাওয়া যায়। এই সভ্যতার মানুষেরা সুতিবস্ত্র ব্যবহার করত এবং অলংকার হিসাবে তারা সোনা, রূপোর অলংকার ব্যবহার করত।

    শ্রেণীবৈষম্য  সিন্ধু সভ্যতার সমাজ জীবনে শ্রেণীবৈষম্য বিশেষভাবে লক্ষনীয়। বড় প্রাসাদ ও ছোট বাড়ি দেখে বোঝা যায় ধনী-দরিদ্রের শ্রেণীবৈষম্য। সিন্ধু সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিল।


   উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রাচীনকালের একটি অন্যতম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। এই সভ্যতার আগে পৃথিবীতে এত বড় নগর সভ্যতার বিকাশ আর কোথাও ঘটতে দেখা যায়নি। এই সভ্যতার প্রায় প্রতিটি নগর গড়ে উঠেছিল কোন না কোন নদীকে কেন্দ্র করে। তাই, এদিক থেকে বিচার করলে সিন্ধু সভ্যতাকে নদীমাতৃক সভ্যতাও বলা যেতে পারে।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading