স্ব-শক্তিশালী আন্দোলন (Self-Strengthening Movement) – তাৎপর্য:
স্ব-শক্তিশালী আন্দোলন ছিল চীনের চিং সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক প্রচেষ্টা, যা ১৮৬১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত চলেছিল। চীনের সমাজ, সামরিক বাহিনী এবং অর্থনীতির আধুনিকীকরণ করার উদ্দেশ্যে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পশ্চিমী শক্তির আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে, চীন তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং বিদেশি শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে আধুনিক প্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামরিক কৌশল গ্রহণ করার প্রয়াস চালায়। তবে, আন্দোলনটি পুরোপুরি সফল হয়নি, কারণ এটি বেশ সীমিত ছিল এবং মূলত সামরিক ও শিল্পে আধুনিকীকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রেক্ষাপট ও প্রেরণা:
১৮শ শতকের শেষভাগ এবং ১৯শ শতকের প্রথম ভাগে চীন একের পর এক পরাজয়ের মুখোমুখি হয়, বিশেষ করে আফিম যুদ্ধের পর। প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২) এবং দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ (১৮৫৬-১৮৬০) চীনের সমরসামগ্রী এবং রাজনৈতিক শক্তির সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে চীন পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেশীয় সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। চীনের সম্রাট, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এবং সেনাপতিরা বুঝতে পারেন যে, পশ্চিমী শক্তি ও তাদের আধুনিক প্রযুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয় যদি না তারা নিজেদের সামরিক, শিল্প, শিক্ষা ও প্রশাসনিক কাঠামোকে আধুনিক করে তোলে।
এই পরিস্থিতিতে চীনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, বিশেষত টুং চি (Tongzhi) সম্রাটের অধীনে, একটি শক্তিশালী এবং আধুনিক চীন গঠনের জন্য একটি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৮৬১ সালে “স্ব-শক্তিশালী আন্দোলন” নামে একটি সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল চীনের ঐতিহ্যবাহী কাঠামোতে আধুনিকতা ও পরিবর্তন আনা।
আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
স্ব-শক্তিশালী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল চীনের দুর্বল সামরিক বাহিনী, শিল্প ও প্রশাসনিক কাঠামোকে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে শক্তিশালী করা। এর মধ্যে কিছু প্রধান উদ্দেশ্য ছিল:
- সামরিক আধুনিকীকরণ: আফিম যুদ্ধের পর চীনা সেনাবাহিনী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পশ্চিমী দেশগুলো তাদের আধুনিক অস্ত্র এবং যুদ্ধ কৌশল দ্বারা চীনের প্রতিরোধ সহজেই ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। তাই, চীন সেনাবাহিনীতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ কৌশল এবং প্রশিক্ষণ আনার জন্য উদ্যোগী হয়।
- শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন: চীন তখনো পুরনো কৃষি সমাজে আবদ্ধ ছিল এবং তাদের শিল্পে তেমন অগ্রগতি ছিল না। এই আন্দোলন চীনের শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিল এবং বিদেশী প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে শিল্প খাতে উন্নয়ন সাধন করার চেষ্টা করেছিল। বিশেষ করে, নৌবাহিনী, রেলপথ, এবং অন্যান্য কলকারখানার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি গ্রহণের প্রচেষ্টা ছিল।
- শিক্ষা সংস্কার: পশ্চিমী বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল, এবং চীনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া শুরু হয়। চীন শিক্ষা ব্যবস্থায় পশ্চিমী মডেল গ্রহণের চেষ্টা করেছিল যাতে চীনা নাগরিকদের আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ করা যায়।
আন্দোলনের কার্যক্রম:
স্ব-শক্তিশালী আন্দোলনের সময় কিছু সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও ছিল। কিছু উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ছিল:
- সেনাবাহিনীতে আধুনিকীকরণ: চীনের সেনাবাহিনীতে নতুন অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ কৌশল সংযোজন করা হয়। বিশেষ করে, আধুনিক যুদ্ধজাহাজ এবং সৈন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।
- কারখানা স্থাপন: চীন বিভিন্ন কারখানা স্থাপন করে, যেখানে মেশিন এবং যন্ত্রপাতি উৎপাদন করা হয়। যদিও এটি পশ্চিমী শিল্প বিপ্লবের তুলনায় খুবই সামান্য ছিল, তবে এটি চীনে একটি নতুন শিল্প বিপ্লবের সূচনা ছিল।
- শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন: চীনে পশ্চিমী শিক্ষা পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেক নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে বিজ্ঞানের উপর জোর দেওয়া হয়। তবে, এই শিক্ষা ব্যবস্থা চীনের দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না এবং তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।
আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা:
এটি বলাই যায় যে, স্ব-শক্তিশালী আন্দোলন চীনের আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং একে পূর্ণাঙ্গভাবে সফল বলা যায় না। এর কিছু প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল:
- সংস্কারের সীমিত পরিসর: আন্দোলনটি মূলত সামরিক ও শিল্প খাতে সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনেক কিছুই অব্যাহত ছিল।
- অভ্যন্তরীণ বিরোধ: চীনের সরকারের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা ছিল না। সংস্কারের পক্ষে এবং বিপক্ষে উভয় পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। একদিকে, আধুনিকীকরণের সমর্থকরা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছিল, অন্যদিকে, প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষায় মনোযোগী অনেক পদস্থ কর্মকর্তা সংস্কারের বিরোধিতা করছিলেন।
- বিদেশি চাপ: চীন তখনো পশ্চিমী শক্তির প্রতি নির্ভরশীল ছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাদের কাছে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে, তাদের আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা অনেকটাই ব্যাহত হয়েছিল।
পরিণতি:
স্ব-শক্তিশালী আন্দোলন চীনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিবর্তন আনলেও, এটি দেশকে পশ্চিমী শক্তির আক্রমণ ও আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে পারেনি। এই আন্দোলন চীনের আধুনিকীকরণের পথে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তবে তা অপর্যাপ্ত ছিল। তবে, এর প্রভাব চীনে সংস্কারের প্রতি আগ্রহ এবং পশ্চিমী প্রযুক্তি গ্রহণের ধারণাকে চীনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে।
পরবর্তীতে, ১৯শ শতকের শেষের দিকে চীনে ব্যাপক পরিবর্তন ও বিপ্লবের সূচনা হয়, যা স্ব-শক্তিশালী আন্দোলনের পরবর্তী প্রক্রিয়া হিসেবে চীনের আধুনিক ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।