কনৌজপাতি হর্ষবর্ধন :
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন ‘মহারাজাধিরাজা’ হর্ষ শিলাদিত্য। বনভট্টের ‘হর্ষচরিত’ এবং চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাত্তার বিবরণের মাধ্যমে তিনি অমর হয়ে আছেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর হর্ষবর্ধনের প্রধান কৃতিত্ব ছিল একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি বিভক্ত ও খণ্ডিত ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা।
ঐতিহাসিক উপাদান :
হর্ষবর্ধনের রাজত্বের ইতিহাস জানতে আমাদের প্রধানত কয়েকটি সূত্রের উপর নির্ভর করতে হবে- ১) হর্ষবর্ধনের কবি বনভট্টের হর্ষচরিত, ২) চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর বিবরণ, ৩) সমসাময়িক লেখা, ৪) ‘আইহোল টেক্সট’। জৈন কবি রবিকীর্তি। হর্ষবর্ধনের রাজত্বের ঐতিহাসিক উপাদান, বিশেষ করে সাহিত্য উপাদানের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাই এই উপাদানগুলি সাবধানতার সাথে ব্যবহার করা উচিত।
হর্ষবর্ধনের সিংহাসন লাভ :
উত্তর ভারতের ইতিহাসের এক সংকটময় মুহূর্তে, হর্ষবর্ধন থানেশ্বর ও কনৌজের শাসক হন। পিতা প্রভাকরবর্ধন দিল্লির কাছে থানেশ্বরে একটি ছোট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধন প্রায় ৬০৪ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের পৈতৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। মালবদেশ, দেবগুপ্ত এবং গৌড়রাজ শশাঙ্কের শাসকরা রাজ্যবর্ধনের স্বামী কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে, রাজ্যবর্ধনের বোনকে পরাজিত ও হত্যা করলে এবং রাজ্যশ্রীকে বন্দী করলে রাজ্যবর্ধন প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে যায়। বনভট্টের ‘হর্ষচারী’-এ এই ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায় যে গৌড় রাজা শশাঙ্কের ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জন্য রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু হয়েছিল। এইভাবে, থানেশ্বরের সিংহাসন শূন্য হলে, রাজ্যবর্ধনের ছোট ভাই হর্ষবর্ধন 606 খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
গৌড়রাজ শশাঙ্কের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যর্থতা :
606 খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর হর্ষের দুটি প্রধান দায়িত্ব ছিল। প্রথমত, ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করা; দ্বিতীয়ত, ভাই রাজ্যবর্ধনের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া। হর্ষবর্ধন কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। এভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে, হর্ষবর্ধন তার উদ্দেশ্য পূরণের দিকে এগিয়ে গেল। বিন্ধ্য পর্বতের বনাঞ্চল থেকে রাজশ্রীকে উদ্ধার করার পর,হর্ষবর্ধন গৌড়ের অধিপতি শশাঙ্কের সাথে যুদ্ধ করতে এগিয়ে যান। পূর্ব থেকে ভাস্করবর্মা এবং পশ্চিম থেকে হর্ষবর্ধন একই সাথে শশাঙ্ককে আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু শশাঙ্কের জীবদ্দশায় হর্ষবর্ধন তাকে পরাজিত করতে পারেননি। চূড়ান্ত নথি অনুসারে, শশাঙ্ক 637-38 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৌড়বঙ্গে তার ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্যভাবে উপভোগ করেছিলেন।
উত্তর ভারত জয় :
বিজয়ী হর্ষবর্ধন সমগ্র উত্তর ভারতে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। হর্ষবর্ধন হাতি ও পদাতিক বাহিনীকে ভর করে তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। হিউয়েন সাও-এর বিবরণ দেখায় যে হর্ষবর্ধন তার বিশাল সেনাবাহিনীর সাহায্যে সমগ্র উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। যারা স্বেচ্ছায় তাঁর কর্তৃত্বের কাছে নতি স্বীকার করেনি, তিনি পদচ্যুত করেছেন।
চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর নিকট পরাজয় :
উত্তর ভারতে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পর, হর্ষবর্ধন দাক্ষিণাত্যে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে এগিয়ে যান। চালুক্য রাজাদের বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে তিনি নর্মদা নদী পর্যন্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে দক্ষিণ ভারত জয়ের জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে নর্মদা নদীর তীরে চালুক্য রাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি লাভবান হতে পারেননি।
সাম্রাজ্যের আয়তন :
হর্ষের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্বন্ধে নানা মতভেদ বর্তমান। ঐতিহাসিক পানিক্করের মতে, হর্ষের সাম্রাজ্য কামরূপ থেকে কাশ্মীর ও হিমালয় থেকে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
উত্তর ভারতের শেষ সম্রাট :
হর্ষকে অনোকেই উত্তর ভারতের সর্বশেষ সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন (‘সকালোত্তরপথনাথ’) অর্থাৎ হয়ই ছিলেন উত্তর ভারতের শেষ সাম্রাজ্যস্রষ্টা। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এই উক্তিটি ভ্রান্ত। তিনি মনে করেন না যে উত্তর ভারতে হবই সাম্রাজ্য বিস্তারের শেষ চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের সকল প্রচেষ্টা নির্মূল হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে হর্ষের মৃত্যুর পর প্রায় পাঁচ শতাব্দী যাবৎ উত্তর ভারতে অনেক সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটেছে। এদের কোনোটিই হর্ষের সাম্রাজ্যের অপেক্ষা ক্ষুদ্র ছিল না। গুর্জর প্রতিহার সাম্রাজ্য শুধু অর্থের সাম্রাজ্যের চেয়ে বৃহত্তরই ছিল না, স্থায়িত্বের দিক থেকেও এটি দীর্ঘতর হয়েছিল। তথাপি বহুদিক থেকে তাঁর রাজত্বকাল ভারত ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতে প্রথম এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত যে রাজনৈতিক অনৈক্য, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল হর্ষবর্ধন বহুলাংশে সেই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে উত্তর ভারতের অখন্ডতা ফিরিয়ে এনেছিলেন।
শাসন ব্যবস্থা :
যদিও হর্ষবর্ধনের প্রবর্তিত নিয়মে মৌর্য যুগের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, হিউয়েন সাং-এর বিবরণ থেকে পাওয়া তথ্যে তাঁর শাসনের উদার চরিত্র সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি প্রধানত গুপ্ত শাসন ব্যবস্থা অনুসরণ করতেন। বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিটি বিভাগ ব্যক্তিগতভাবে হর্ষ নিজেই নিরীক্ষণ ও পরিচালনা করতেন। নীতি শাসন স্বৈরাচারী হলেও জনগণেরও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ছিল। প্রশাসনিক কার্যাবলী ছাড়াও, এই মন্ত্রী পরিষদ উত্তরসূরি নিয়োগ এবং পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ দেয়। হর্ষের রাজত্বকালে একটি সুসংগঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় বিদ্যমান ছিল বলে জানা যায়। রাজ্যের সেবকদের বলা হত ‘মহাসামন্ত, মহারাজ, পরমাতর, রাজস্থানীয়, কুমারমাত্য, আবিয়াপতি। হর্ষ তার সাম্রাজ্যকে প্রদেশ, বিভাগ ও জেলায় ভাগ করেছিলেন। প্রতিটি প্রদেশকে কয়েকটি ‘ভুক্তি’ এবং প্রতিটি ‘ভুক্তি’কে কয়েকটি “বিষয়”-এ ভাগ করা হয়েছিল। রাজ্যে তিন ধরনের কর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ভূমি রাজস্ব বলা হত ‘ভাগ’। ‘ভাগ’ শস্যে দেওয়া হত। যিনি কর দিতেন তাকে বলা হতো ‘হিরানা’। আরেকটির নাম ছিল ‘তার বলি’। হর্ষের সময়ে প্রচলিত দণ্ডবিধি অনেকাংশে নম্র ছিল। শারীরিক শাস্তি প্রায় পরিত্যক্ত ছিল। কিন্তু হিউয়েন সাং-এর বিবরণ দেখায় যে রাজ্যের রাস্তাগুলি সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল না। চীনা ভ্রমণকারীকে বারবার ডাকাতদের দ্বারা লাঞ্ছিত করা হয়েছিল।
ধর্ম :
ধর্মের প্রতি নিষ্ঠার জন্য হর্ষবর্ধন সমগ্র ভারতের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অর্জন করেছিলেন। হর্ষ ধর্মীয়ভাবে একজন শৈব ছিলেন, কিন্তু তিনি আদিত্য এবং অন্যান্য দেব-দেবীদেরও পূজা করতেন। পরবর্তী জীবনে হয় বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন, বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, কিন্তু সম্ভবত কখনোই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হননি।
সাহিত্য ও শিক্ষানুরাগ :
হর্ষের সাহিত্যানুরাগ সর্বজনবিদিত। তিনি রাজ্যের রাজস্ব থেকে দেশের গুণী এবং পণ্ডিতদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ্-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে হর্ষবর্ধন রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ সাহিত্যসেবীদের জন্য ব্যয় করতেন। ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও বহু গুণী ব্যক্তির সমাবেশে হর্ষের রাজসভায় হয়েছিল। তাদের মধ্যে ‘কাদম্বরী’ ও ‘হর্ষচরিত’ প্রণেতা সভাকবি বাণভট্ট ছিলেন প্রধান। হর্ষের উৎসাহেই পাঁচশো শ্লোক সমন্বিত বুদ্ধের পূর্ব জীবনের ঘটনাবলি নিয়ে ‘জাতকমালা’ রচিত হয়। অন্যান্য গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন বাণ, ময়ূর, দিবাকর প্রমুখ। হর্ষ নিজে ‘রত্নাবলী’, ‘প্রিয়দর্শিকা’ ও ‘নাগানন্দ’ নামক নাটকগুলি রচনা করেন। এই অর্থে হয় সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত অপেক্ষা সৌভাগ্যবান। কেননা তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বৌদ্ধ ধর্মের বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় হর্ষের অর্থানুকূল্য লাভ করেছিল।
উপসংহারঃ
বিজেতা, দক্ষ প্রশাসক, ধর্মপরায়ণ ও শিক্ষিত ছিলেন প্রাচীন ভারতের একজন আদর্শ মানুষ। তিনি নিঃসন্দেহে উত্তর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন। তিনি রাজ্যের ভয়ানক দুর্দিনে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাঁর ক্ষমতার দ্বারা তিনি রাজ্যের মর্যাদা রক্ষা করেন এবং উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি তাঁর প্রজ্ঞা ও সুশাসনের জন্য সমসাময়িক বুদ্ধিজীবীদের প্রশংসা ও সম্মান অর্জন করেছিলেন। এই অদম্য রাজপুত্র রাজ্যের সমস্ত মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পায় তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা করেছিলেন। গুপ্ত রাজবংশের দৌহিত্র হর্ষবর্ধন গুপ্ত যুগের গৌরব ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু গৌরব ও ঐশ্বর্যের যে মহিমা দিয়ে তিনি ‘মহোদবশ্রী’ বা কনৌজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা তাঁর মৃত্যুর পরেও ম্লান হয়নি। চীনা পরিব্রাজকদের বিবরণ থেকে মনে হয়, তিনি তার বর্ণ-নিরপেক্ষ সহনশীলতা, উদার ধার্মিকতায় অশোকের আদর্শ অনুসরণ করেছেন। সুদক্ষা জোশা এবং সুশাশক তার রাজ্যসভায় সেমুখের বিদ্রোহী। আদর করেছিলেন।