কীভাবে স্বাধীন কোচবিহার রাজ্যের সার্বভৌমত্বের অবসান হয়েছিল আলোচনা করো। Discuss how the sovereignty of the Independent state of Cooch Behar came to an end.

ইংরেজ শাসনাধীন উত্তরবঙ্গে একদিকে যেমন ইজারাদি, রাজস্বনীতি, শাসনহীন অরাজকতা আর দুর্ভিক্ষে জনসাধারণের নাভিশ্বাস উঠছিল-অন্যদিকে তেমনি উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক রাজ্যদ্বয় কোচবিহার ও বৈকুন্ঠপুরে চরম দুরবস্থা দেখা দেয়। মহারাজ বাসুদেবনারায়ণ (1680-1682)-এর সময় থেকেই কোচবিহার রাজ্যে দুর্দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে। একদিকে মুসলমান আক্রমণ, পশ্চিম থেকে বৈকুন্ঠপুরে হামলা, উত্তর থেকে ভুটিয়াদের আক্রমণ, রাজপরিবারের অন্তর্কলহ একদা প্রতাপশালী এই রাজশক্তিকে সম্পূর্ণ অসহায়, দুর্বল এবং সংকুচিত করে ফেলেছিল।

কোচবিহার রাজ্যের ওপর ভুটিয়াদের আক্রমণের তীব্রতা অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ক্রমাগত বাড়তে থাকে। মহারাজ উপেন্দ্রনারায়ণ ও দেবেন্দ্রনারায়ণের সময় কোচরাজ্যের উত্তর সীমানার বিপুল অংশ ভুটিয়ারা দখল করে নেয় এবং কোচবিহারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও রাজ্যশাসনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ শুরু হয়। কোচ রাজসভায় পেনসুৎমা-কে প্রায় স্থায়ীভাবে ভুটানের রাজপ্রতিনিধি করে পাঠানো হয়। তাঁর অনুমতি ছাড়া সরকারের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না। 1770 খ্রিস্টাব্দে ভুটানরাজ কৌশলে কোচরাজ ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণকে বন্দি করে রাজধানী পুনাখে নিয়ে যান। অতএব পেনসুৎমা রাজেন্দ্রনারায়ণকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজেই রাজ্যশাসন করতে থাকেন। ভুটানি আধিপত্যে ক্ষুদ্ধ নাজিরদেব ও অন্যান্য রাজকর্মচারীগণ রাজেন্দ্রনারায়ণের অকালমৃত্যুতে 1772 খ্রিস্টাব্দে পেনসুৎমার আপত্তি সত্ত্বেও, নাবালক ধরেন্দ্রনারায়ণকে সিংহাসনে বসান। ক্ষুদ্ধ ভুটানরাজ 40 হাজার সৈন্যসহ কোচবিহার আক্রমণ করেন। নাজিরদেব কাশীশ্বর লাহিড়ি এই আক্রমণ প্রতিহত করেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভুটানরাজের আতুস্পুত্র 1৪ হাজার সৈন্যসহ কোচবিহার আক্রমণ করেন। সত্ত্বামিনি নামক স্থানে ভয়াবহ যুদ্ধে কোচসৈন্য পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসারণ করে। নাবালক রাজা ধরেন্দ্রনারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে রাজমাতা রংপুরে আশ্রয় নেন।

পরিত্যক্ত রাজপুরীতে বিজয়ী সৈন্য ভয়ংকর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে। লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে নিরীহ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার রাজধানীর সাধারণ মানুষের জীবনে বিভীষিকা নিয়ে আসে। সেনাপতি জিম্পে কোচবিহার প্রাসাদে মূল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অবস্থান করেন এবং অবশিষ্ট সৈন্যবাহিনী দিয়ে রাজ্যের প্রত্যন্ত প্রদেশে দখল কায়েম করতে পাঠান। তা ছাড়া তিনি গীতালদহ, মওয়ারী, বালাডাঙ্গা প্রভৃতি স্থানে নতুন দুর্গ নির্মাণ করে বিজিত রাজ্যে আপন ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করতে থাকেন।

যাই হোক, 1772 সালে ভুটানরাজ সম্পূর্ণ কোচরাজ্য গ্রাস করে রাজধানীতে প্রবেশ করলে নাবালক রাজা ধরেন্দ্রনারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে রাজমাতা পাঙ্গাতে আশ্রয় নেন এবং ইংরেজ সৈন্যের সাহায্যে রাজ্যোম্বারের চেষ্টায় ব্রতী হন। বাংলার গভর্নর তখন ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। দিনাজপুরে কোম্পানির এজেন্ট মিস্টার হেরিসের মাধ্যমে কোচবিহাররাজ প্রস্তাব পাঠালেন যে, কোম্পানিকে কোচবিহার সরকার একলক্ষ নারায়ণী স্বর্ণমুদ্রা দেবে, বিনিময়ে ইংরেজ সৈন্য কোচবিহার থেকে ভুটানিদের তাড়িয়ে ধরেন্দ্রনারায়ণকে সিংহাসনে বসাবে। ক্ষমতালোভী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের গভর্নর হেস্টিংস এতে সম্মত হলেন না। তারা কোচবিহারকে বার্ষিক কর দিতে এবং রাজনৈতিক পাহারায় আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হতে বাধ্য করে, তবেই সামরিক সাহায্য দিতে রাজি হয়। নিরুপায় এবং রাজ্যহীন কোচবিহাররাজ নিজের শেষ অস্তিত্বটুকু রক্ষা করতে উক্ত শর্তে রাজি হয়। এইভাবেই আড়াইশো বছরের পুরোনো কোচরাজশক্তির সার্বভৌমত্ব ইংরেজের হাতে চলে যায়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading