ভারতীয় আলঙ্কারিকদের মধ্যে এমন কিছু চিন্তাবিদ আছেন, যারা অলঙ্কারকে কাব্যের আত্মা বলে মনে করেছেন। তাঁদের মতে, কাব্যের আসল সৌন্দর্য অলঙ্কারেই নিহিত, আর এই অলঙ্কার কাব্যের প্রাণ। এই চিন্তাধারা মূলত প্রাচীন ভারতের কাব্যতত্ত্বের সেই ধারা থেকে এসেছে যেখানে অলঙ্কারের মাধ্যমে কাব্যের শৈল্পিক ও রসিক মান নির্ধারণ করা হয়।
অলঙ্কারের গুরুত্ব এবং কাব্যের আত্মা হিসেবে বিবেচনা
আলঙ্কারিকদের মতে, কাব্যকে সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলার জন্য অলঙ্কারের প্রয়োগ অপরিহার্য। অলঙ্কার মূলত শব্দ ও অর্থের বিশেষ অলংকরণ যা কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ, উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি অলঙ্কারগুলো কাব্যের ভাষাকে সুন্দর ও জীবন্ত করে তোলে। এই আলঙ্কারিকরা বিশ্বাস করেন যে, কাব্যের প্রাণ তার ভাষার অলঙ্কারেই নিহিত। কাব্যের মূল উদ্দেশ্য হল শ্রোতা বা পাঠকের মনে একটি স্থায়ী ও গভীর প্রভাব সৃষ্টি করা। অলঙ্কার সেই মাধ্যম যা এই প্রভাব সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। তাই অলঙ্কার ছাড়া কাব্য নিঃসঙ্গ, প্রাণহীন।
চিন্তাধারার তাৎপর্য
এই চিন্তাধারার প্রধান তাৎপর্য হলো, কাব্যের রূপকে অতিমূল্যায়ন করা। এখানে কাব্যের অন্তর্নিহিত ভাব বা রসের চেয়ে তার বাইরের রূপ বা অলঙ্কারকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আলঙ্কারিকদের মতে, কাব্যের প্রধান লক্ষ্য শ্রোতা বা পাঠকের চোখে ও মনে একটি দৃশ্যমান ও শ্রুতিমধুর প্রভাব সৃষ্টি করা। এই প্রভাবের জন্য অলঙ্কার অপরিহার্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভামহ ও দণ্ডী প্রমুখ আলঙ্কারিকরা অলঙ্কারের গুরুত্বকে উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁদের মতে, কাব্যের সৌন্দর্য এবং তার অর্থবোধকতা অলঙ্কার নির্ভর।
সমালোচনা
যদিও অলঙ্কার কাব্যের সৌন্দর্য বাড়াতে সাহায্য করে, একে কাব্যের আত্মা বলা সঠিক নয়। প্রথমত, অলঙ্কারের অতিমূল্যায়ন কাব্যের ভাব বা রসের গুরুত্বকে কমিয়ে দেয়। কাব্যতত্ত্বের আরও আধুনিক চিন্তাবিদ যেমন আচার্য মম্মট এবং অন্যান্যরা এই ধরণের ধ্যানধারণার সঙ্গে পুরোপুরি একমত ছিলেন না। তাঁরা বলেন, কাব্যের মূল আত্মা হলো রস, এবং রস ছাড়া কাব্য প্রাণহীন। অলঙ্কার হলো কেবল একটি বাহ্যিক রূপ যা রসের প্রকাশকে আরও সুন্দর করে তোলে, কিন্তু রসই কাব্যের আসল প্রাণশক্তি।
দ্বিতীয়ত, অলঙ্কারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কাব্যের গভীরতা এবং অন্তর্নিহিত ভাবকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। কাব্যের সফলতা কেবলমাত্র তার অলঙ্কারে নয়, বরং তার ভাবের গভীরতায় এবং সেই ভাবের সুসমন্বিত প্রকাশে নিহিত। অতিরিক্ত অলঙ্কার ব্যবহারে কখনও কখনও কাব্যের মূল ভাব অবজ্ঞাত হতে পারে। যেমন একটি মসৃণ ও মার্জিত অলঙ্কারে ভরপুর কাব্য অনেক সময় তার অন্তর্নিহিত আবেগ বা রসকে ছাপিয়ে যায়।
উপসংহার
যদিও অলঙ্কার কাব্যের সৌন্দর্য বাড়ায়, একে কাব্যের আত্মা বলা হয়তো প্রাচীন আলঙ্কারিকদের চিন্তায় উপযুক্ত মনে হলেও, আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি যথেষ্ট নয়। কাব্যের আসল আত্মা হলো তার রস, যা পাঠক বা শ্রোতার মনে একটি গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। অলঙ্কার সেই রসের বাহন হতে পারে, কিন্তু কাব্যের প্রাণ নয়। অতএব, অলঙ্কারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তবে কাব্যের মূল ভিত্তি হিসেবে নয়, বরং একটি সজ্জা হিসেবে, যা কাব্যের অন্তর্নিহিত ভাবের গভীরতাকে আরও সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলে।