ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হল 1770 সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষ মূলত ইংরেজের ভুল রাজস্বনীতির ফল এবং এই দুর্ভিক্ষে যে বিপুল জীবনহানি হয় তা প্রধানত শাসকশ্রেণি তথা তাদের অধ্যয়ন আমলা ও সহযোগী বণিকশ্রেণির নির্দয়তা ও সাহায্যহীনতার ফল। এই দুর্ভিক্ষে সারা বাংলার প্রায় 30 ভাগ লোক, কৃষকশ্রেণির মধ্যে শতকরা 50 ভাগ লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শাসকশ্রেণি সাহায্যের হাত তো বাড়ায়নি, উপরন্তু এই দুর্ভিক্ষের বছরেও করের হার বাড়ানো হয়েছে এবং আদায়ে কোনো শৈথিল্য দেখানো হয়নি। উত্তরবঙ্গের প্রায় সর্বত্রই এই দুর্ভিক্ষের প্রচণ্ডতা অনুভূত হয়। তার মধ্যে রংপুরেই চাষিদের অবস্থা সর্বাধিক সঙ্গিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষ 1776 বঙ্গাব্দে হয়েছিল বলে একে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বলা হয়। এই দুর্ভিক্ষে বহুগ্রাম লোকশূন্য হয়ে যায় এবং বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বসতি এলাকা জঙ্গলে পরিণত হয়। দলে দলে লোক চুরি, ডাকাতি ও দস্যুবৃত্তিতে যোগ দেয়। দেশ সম্পূর্ণ অরজাকতায় ছেয়ে যায়। ঐতিহাসিককালের মধ্যে এমন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ভারতের আর কোথাও হয়নি এবং শাসকশ্রেণির অবজ্ঞা, ঔদাসীন্য আর নির্দয়তায় এত বেশি লোকমৃত্যু আর কোথায় ঘটেনি। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণই সেদিন শুধু ক্ষুদ্ধ হয়েই উঠেছিল তা নয়, কোম্পানির অনেক দায়িত্বশীল কর্মচারীই সেদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজ্য পরিচালনার চূড়ান্ত অপদার্থতায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। দুর্ভিক্ষের বছরের আগে থেকেই যে ইংরেজের শাসনের ভয়াবহ কুফল দেশের ওপর প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ কোম্পানি কোর্ট অব ডাইরেক্টরের নিকট 1769 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে কোম্পানিরই উর্ধ্বতন কর্মচারী রিচার্ড বীচার-এর লেখা পত্রে পাওয়া যায় এই পত্রে তিনি লিখেছিলেন, “আমি জানি, একথা শুনতে যে-কোনো ইংরেজ লোকই বাথা পাবে যে, কোম্পানি এ দেশের ‘দেওয়ানি’ লাভের পর থেকেই এ দেশের অবস্থা পূর্বের থেকে খারাপ হয়েছে তবু এ সত্য সন্দেহের অতীত। এই সুন্দর দেশ, যা একনায়কী ও স্বৈরতন্ত্রী শাসনেও বিকাশশীল হয়ে উঠেছিল, তা আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে।”