দীনবন্ধুমিত্রের নীলদর্পণ যে রসের নাটক এখানকার চরিত্রগুলি বিচার কালে সেই রসের দিকটিকেই আগে বিচার করে দেখতে হবে। যে চরিত্র যে বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত, তাদের মধ্যে সেই সেই উপাদান নাট্যকার কতখানি বাস্তব সম্মতভাবে খন্ডিত করতে পেরেছেন, তার বিচারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিচারে নাট্যকার জনসাধারণ ও দুষ্ট চরিত্রাঙ্কনে অসাধারণ বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিলেও তথাকথিত সৎ ও সাধু প্রকৃতির ভদ্র চরিত্র অঙ্কনে ততটা সার্থক হননি। এদের ব্যবহার, ভাষা ইত্যাদি অত্যন্ত কৃত্রিম হয়ে পড়েছে বলা যায়। এই নাটকে নাট্যকার রায়ত শ্রেনী, মধ্যবিত্ত শ্রেনী ও ইংরেজ চরিত্র এই তিন শ্রেনীর চরিত্রকে উপস্থিত করেছেন। কিন্তু এর মধ্যে রায়ত বা ভদ্রেতর চরিত্র অঙ্কনেই তিনি সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছেন। তৎকালীন বাংলার সমাজ জীবনে এরা তাদের স্বাভাবিক আচরণ ও মৌখিক ভাষা নিয়ে বিচরণ করেছিল। তাদের মধ্যে থেকে নাট্যকার যেন তোরাপ, আদুরী, রেবতী, ক্ষেত্রমণি, পদি ময়রাণী ও অন্যান্য রায়তদের তুলে এনে নাটকে স্থান দিয়েছেন।
তোরাপ চিত্রটিকে নাট্যকার প্রায় একটি ‘টাইপ’ চরিত্র হিসাবে গড়ে তুলেছেন। সে বীরত্ব, কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক। সে একজন সাধারণ মুসলমান কৃষক হলেও নবীনের মত কিছু মূল্যবোধ তার ছিল। পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে সাধুচরণকে সে বলেছে, সুযোগ পেলেও সে উডকে হত্যা করবে না খোদার জীব পরানে মাত্তাম না।” আবার যখন তাকে জোর করে গোলক বসুর বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষি দিতেবলেছে তখন সে বলেচে ‘ম্যারে ক্যান ফ্যালায় না, মুই নেমুখ্যারামি কন্ডি পারব না।” এই দৃঢ় চিত্ত তোরাপ তাই ক্ষেত্রমনির উদ্ধার দৃশ্যে রোগসাহেবকে বাগে পেয়ে তার আক্রোশকে মিটিয়েছে। কিন্তু পঞ্চম অঙ্কে এই তোরাপই যখন বলে-
“মুইএখন গোলার মধ্যে নুকায়্যে থাকি, নাত কর্যে
পেলয়্যে যাব, সমিন্দি নাকের জন্যি গাঁ নসাতলে পেটয়ে দেবে।”
তখন তার মধ্যে ভদ্রেতর চরিত্রের ভীরু সরল প্রকৃতিটি প্রকাশ পায় সুতরাং তোরাপের চরিত্রের উজ্জল মুহূর্ত হল উড রোগকে শারিরীক শাস্তি বিধানে নয়, নবীন মাধবকে উডের আক্রমণ থেকে উদ্ধার করতে না পারার জন্য আক্ষেপ।
“আল্লা! বড়বাবু মোরে এতবার বাঁচালে মুই বড় বাবুরি
অ্যাকবার বাঁচাতি পাল্লাম না। (কপাল যা মারিয়া রোদন)
তখন একজন সামান্য কৃষকের ভেতর থেকে মূল্যবোধ সম্পন্ন একজন সদাশয় ব্যাক্তির অসহায় ট্র্যাজেডি ফুটে ওঠে।
আদুরী চরিত্র সম্পর্কে অনেকেই বলেছেন নিছক হাস্যরস সৃষ্টি জন্যই নাট্যকার এই চরিত্রটির সৃষ্টি করেছেন। নাটকে আদুরি ও সৈরিন্ধ্রীর কথোপকথোনের মাধ্যমে নাট্যকার হাস্যরস পরিবেশন করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে দিবে চরিত্রটি নানা প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে বসু পরিবারের নানা তথ্য, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইন, সাহেব বিবির নষ্টামী প্রভৃতি। এর মধ্যেই আদুরীর গভীর স্বামীপ্রেমের সঙ্গে অতৃপ্ত জীবন তৃষ্ণাও ফুটে ওঠে। আদুরীকে নাট্যকার এক প্রাচিন পরিবারের ঝি রূপেই এঁকেছেন, যে ঐ পরিবারেই একজন হয়ে গেছে। তাই বসু পরিবারের বিপর্যয়ে তার সকল পরিহাস বিলীন হয়ে গেছে।
রেবতী সাধুচরণের স্ত্রী। অশিক্ষিতা গ্রাম্য রমণী রেবতী চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য তার মাতৃত্ব। শুধু কন্যা ক্ষেত্রমণির প্রতি নয়, দেবর রাইচরণের প্রতিও তার আচরণ এই মাতৃত্বের। তাই রাইচরণকে কুঠিতে ধরে নিয়ে যাবার সময় সে বলেছে-
“ওমা ওষে ডাকা ছেলে, ওযে এতক্ষন দুবার খায় না, খেয়ে সাহেবের কুঠী যাবেকেমন করে, সে যে অনেক দূর।”
বাস্তববোধ সম্পনা, কর্তব্যপরায়না রেবতী মনের মধ্যে যে ধর্মকে সযত্নে লালন করে এসেছে, সে হল নারীর সতীত্ব ধর্ম। কোন কিছুর বিনিময়ে সেই ধর্মকে বিসর্জন দেওয়া যায় না। তাই সে মেয়েকেসাহেবের কাছে পাঠাতে পারেনি। কিন্তু কন্যার মৃত্যু মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তার মনে হয়েছে সেও তার পক্ষে ভালো ছিল।
“সাহেবের সঙ্গি থাকাযে মোর ছিল ভাল মারে, মুখ দেখে
জুড়োতাম মারে।”
এখানে মাতৃত্বের কাছে রেবতীর সকল ধর্ম বিশ্বাস, সতীত্ব বোধ ভেসে গেছে।
ক্ষেত্রমণি এই নাটকের মধ্যে সবচেয়ে হতভাগ্য নারী চরিত্র। সে কৃষকের ঘরে জন্মে অপূর্ব সোন্দর্যের অধিকারী হয়েছে। আর এই সৌন্দর্যই তার জীবনে কাল হয়েছে ‘আপনা মাংসে হরিনা বৈরী’। কৃষক বধু সন্তান সম্ভবা ক্ষেত্রমণিকে তাই রোগ সাহেবের কাম পিপাসার শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু অর্থ নয়, সম্পদ নয়, নারীর প্রকৃত সম্পদ তার সতীত্বকে রক্ষা করতে ক্ষেত্রমণি আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এবং ব্যর্থ হয়ে তৃতীয় গর্ভাস্কে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। এই একটি মাত্র চরিত্রের মাধ্যমে নাট্যকার তৎকালীন সুন্দরী যুবতীদের বাস্তব দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। রোগ সাহেবের গৃহে ক্ষেত্রমণির মুখের ভাষাও ভদ্রেতর চরিত্রের সার্থক স্ফুরণ।
আর নাটকের মধ্যে পদীময়রানীর ভুমিকা খুব বিস্তৃত নয়। তার চরিত্র সম্পর্কে নাটকে পাই। রোগ সাহেবের কু-প্রস্তাব ক্ষেত্রমণির কাছে পদী-ই করেছে, কিন্তু এই পদীর মধ্যেও দেখিবিবেক দংশন উপপতি করিছি বলে কি আমার শরীরে দয়া নেই’। ক্ষেত্রমণিকে নীলকুঠীর কুঠীয়ালদের হাতে সমর্পন করতেও সে আন্তরিক ভাবে চায়নি।