প্রাচীন উত্তরবঙ্গে আর্যকরণ প্রক্রিয়া
উত্তরবঙ্গের আর্যীকরণ প্রক্রিয়া আলোচনা প্রসঙ্গে এই ভৌগোলিক এলাকার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় জানা একান্তই প্রাসঙ্গিক। আধুনিককালে উত্তরবঙ্গ বলতে মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার-এই ছ-টি জেলা নিয়ে গঠিত একটি ভূখণ্ড বা প্রশাসনিক এলাকা বোঝালেও এর পূর্বনাম ছিল পুণ্ড্রবর্ধন বা বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী। এই ভূখণ্ডের জনবিন্যাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় এবং আর্য-এই চারটি জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পর্যায়ক্রমে উত্তরবঙ্গ তথা পুণ্ড্রবর্ধনে বসবাস করত।’
আর্যজাতির বা আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের সর্বপ্রথম উত্তরবঙ্গে আগমন ঘটেনি। এক দীর্ঘ ক্রমপর্যায়ের মধ্যে দিয়ে পুণ্ড্রবর্ধনে আর্যদের আগমন ঘটে। আর্যদের পরিচয় এবং আমি বাসস্থান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তারা যে একটি ভাষাগোষ্ঠী-এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। অর্থাৎ, দশটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় যারা কথা বলত, তারা ‘আর্য’ নামে পরিচিত ছিল। ভারতে আর্যদের আগমন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এ কথা ঐতিহাসিক মহলে স্বীকৃত যে, তাদের একটি শাখা সর্বপ্রথম ভারতে ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে। ঋগবৈদিক যুগে আর্যরা উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পশুচারণ এবং অস্থায়ী কৃষিজীবিকা দ্বারা জীবিকা নির্বাচ করলেও পরবর্তী বৈদিকযুগে আর্যরা উত্তর-পূর্ব ভারতে অর্থাৎ গাঙ্গোয় উপতাকায় স্থানান্তরিত হয়। এই ভৌগোলিক এলাকার উর্বরতা আর্যদের একদিকে যেমন স্থিতিশীল কৃষিজীবিকার সূচনা করে তেমনি তাদের পরিযায়ী জীবনের অবসান ঘটায়।
গাঙ্গেয় উপতাকা থেকে কালানুক্রমে আর্যদের বঙ্গে আগমন ঘটে। অথর্ববেদের পঞ্চমকাণ্ডে ও মগধদেশে আর্যদের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও মানধর্মশাস্ত্র থেকে পুণ্ড্রজাতির কথা জানা যায়। অতএব এ কথা বলা যায় যে, পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গ আর্যদের পরিচিত হয়েছিল। আর্যোপনিবেশের পূর্বে যে প্রাচীন জাতি ভূমধ্যসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নিজ অধিকার বিস্তার করেছিল তারাই ঋগ্বেদে দস্যু নামে পরিচিত। সম্ভবত আর্যজাতির আক্রমণের পূর্বে দ্রাবিডজাতি অধিকার বিস্তার করেছিল। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আর্যদের আগমনের পূর্বে উত্তরবঙ্গ তথা পুণ্ড্রবর্ধনে কোল, ভিল, মুণ্ডা, কিরাত এবং শবর জাতীয় অনার্যরা বসবাস করত। গুপ্তসম্রাট সমূদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে
পুণ্ড্রবর্ধন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় কৌমদের আধিপত্য ছিল। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে আর্যগণ কর্তৃক মগধ ও বঙ্গ অধিকারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে আর্যজাতির বঙ্গা ও মগধ অধিকারের প্রকৃত সময় নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার। সিংহলের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীচ্ছ বা তার পূর্বে মগধ ও বঙ্গে আর্যসভ্যতা প্রসারিত হয়েছিল। বলোর প্রাচীন অধিবাসীরা পুরাতন ভাষা ও রীতিনীতি ত্যাগ করে অর্যেজাতির আচার-ব্যবহার ও ধর্ম গ্রহণ করে এবং এই ধারা পুণ্ড্রবর্ধন তথা উত্তরবঙ্গে বিদ্যমান থাকে, যা ‘আর্যীকরণ প্রক্রিয়া’ নামে পরিচিত। বঙ্গোর প্রাচীন লিপিগুলিতে আর্থীকরণ সম্পন্ন হয়েছে এমন কিছু ভূমির উল্লেখ রয়েছে। এগুলি
হল-পুণ্ড্রবর্ধন, কোটিবর্ষ, পঞ্চগিরি, চন্দগ্রাম, পলাশবৃন্দক এবং শিলাকুণ্ড প্রভৃতি। আর্থীকরণের মূল ক্ষেত্রগুলি ছিল আর্যপূর্ব এবং আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির মিলন। মিশ্রবর্ণের বিবাহ, আর্য ভাষাভাষী লোকেদের সামাজিক সর্বশ্রেষ্ঠতা এবং সর্বোপরি আর্য-অনার্য সংঘর্ষ প্রভৃতি। আর্থীকরণ অর্থাৎ আর্য সংস্কৃতির বিকাশ কিন্তু একদিনে সম্পন্ন হয়নি। নানা বিরোধ, সংঘর্ষ ও মিলনের মধ্য দিয়ে এইসব দস্যু, গেছ
অসুর ও কোমের লোকদের সঙ্গে আর্য ভাষাভাষী লোকেদের পরিচয় ঘটে। এই অনার্য জাতিগুলি ধীরে ধীরে আর্য সমাজব্যবস্থায় স্বীকৃতি ও স্থানালাভ করতে শুরু করে। বাৎসায়নের কামসূত্রে গৌড়বণের বংশ এবং বাঙালির আর্থীকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শুধু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরাই যে আর্য সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা বঙ্গে সম্প্রসারিত করে তা নয়, বরং এক্ষেত্রে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও সমান কৃতিত্বের অধিকারী। মৌর্য ও শুঙ্গ আধিপত্যের সলো সঙ্গে আর্য সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা বঙ্গের পুণ্ড্রবর্ধনভূত্তি তথা উত্তরবঙ্গো বিস্তারলাভ করে। বোধ হয় এই সময়কালেই উত্তর ভারতীয় আর্যরা ব্যাবসাবাণিজ্য, ধর্ম প্রচার এবং রাষ্ট্র কর্ম প্রভৃতিকে আশ্রয় করে বলোর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করে এবং দস্যু, ম্লেচ্ছ, অসুর, কিরাত, কোম প্রভৃতি অনার্য জাতিগুলি আর্য সংস্কার ও রীতিনীতি গ্রহণ করে আর্থীকরণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।