ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের সঙ্গে দার্জিলিং-এর সংযুক্তিকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করো। (Discuss in detail the annexation of Darjeeling by he British during colonial rule.)

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সবচেয়ে উত্তরের জেলাটি হল দার্জিলিং, যা ‘ঈশ্বরের দেশ’ নামেও পরিচিত। এই জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বরাবরই জনমানসে একটি আলাদা স্থান করে রেখেছে। ‘দার্জিলিং’ শব্দটি এসেছে ‘দোজে’ শব্দটি থেকে, যার অর্থ হল ‘বজ্রপাতের স্বর্গীয় রাজদণ্ড’ এবং ‘লিং’ শব্দের অর্থ হল ‘স্থান’, অর্থাৎ বৌদ্ধ লামাদের স্বর্গীয় রাজদণ্ডের একটি স্থান। বর্তমানে দার্জিলিং-এর অবজারভেটরি হিল-এর স্থানে পূর্বে একটি বৌদ্ধমঠের অবস্থান ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সূত্র ধরেই বর্তমান জেলাটির নামকরণ করা হয়েছিল।

দার্জিলিং জেলার সীমানা বিস্তৃত হয়েছে পশ্চিমে নেপাল এবং পূর্বে ভুটানের সঙ্গে এবং উত্তরদিকে সিকিম রাজ্যের সঙ্গে তিস্তা নদীর দ্বারা বিভক্ত হয়ে দক্ষিণে জলপাইগুড়ি ও বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মধ্যে দিয়ে প্রসারিত।

দার্জিলিং জেলা গঠন ও প্রসারণের পূর্বে রয়েছে এক বিস্তৃত ইতিহাস, যা আজ বর্তমান জেলার স্বরূপ সৃষ্টি করেছে। মূলত দার্জিলিং জেলার কোনো প্রাক্-ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ধারা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, কারণ এটি ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের উদাহরণস্বরূপ একটি স্থান অর্থাৎ সিমলা, উটি-র মতো পাহাড় ও সবুজময় পরিবেশের সাদৃশ্য ব্রিটিশরা খুঁজে পেয়েছিলেন এই দার্জিলিং-এর আবহাওয়ায়। এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য দার্জিলিং হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা এবং সরকারি কর্মচারীদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। এই জেলার প্রাকৃতিক অবস্থান ও সীমারেখ ার গুরুত্বের কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশদের কাছে সামরিক সদর দপ্তরের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল দার্জিলিং।

তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে দার্জিলিং জেলার অংশটি সিকিম রাজ্যের অধীন থেকে গৃহীত হয়েছিল। 1835 সালে দার্জিলিং হিল স্টেশন গঠনের আগে এটি ছিল সিকিম রাজ্যের অন্তর্গত। অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নেপালের ক্ষমতা দখলকারী গোর্খারা বেশ কয়েকবার সিকিম আক্রমণ করেছিল। উত্তর সীমান্তের এই বিশৃঙ্খল পরিবেশ বাংলায় অবস্থানকারী ব্রিটিশদের কাছে নতুন সুযোগ এনে দিয়েছিল। 1804 থেকে 1812 সাল পর্যন্ত নেপাল এবং ব্রিটিশদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। অবশেষে 1814 সালের নভেম্বর মাসে সিকিমরাজের সঙ্গে ব্রিটিশ সৈন্যের যৌথ প্রচেষ্টায় গোর্খাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একটি দুর্ধর্ষ অভিযানের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যরা কালি এবং সতলুজ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলটি দখল করে নেয়, যা মূলত নেপালের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। অবশেষে 1816 সালে ‘সগৌলির সন্ধি’র মাধ্যমে নেপালের সলো ব্রিটিশদের সমঝোতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

সিকিমের অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত দিক থেকে উচ্চস্থানের। তাই এই যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের সহায়তা আদতে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ পূর্ণ করার অভিব্যক্তি ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সিকিম ভুটান ও নেপালের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সিকিমরাজ নামগ্যাল (1700-1716) 1706 সালে ভুটানের কাছে তরাইয়ের কিছু অংশ যুদ্ধে হেরে যান। পূর্বে সগৌলির সন্ধির বিরুদ্ধাচারণ করার ফলে ব্রিটিশরা পুনরায় নেপালের সঙ্গে 1817 সালের 10 ফেব্রুয়ারি ‘তিতাল্যার সন্ধি’ স্বাক্ষরিত করে। ফলস্বরূপ মেচি নদী ও তিস্তার মধ্যবর্তী 4000 বর্গমাইল এলাকাটি সিকিমরাজকে অর্পণ করা হয়। এই সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি সনদের মাধ্যমে এবং কোম্পানি সিকিমে ‘সর্বোচ্চ ক্ষমতা’র অবস্থান গ্রহণ করে পরবর্তীতে সিকিম ও নেপালের মধ্যে যে-কোনো রকমের বিরোধের সালিশি করার সুযোগ পায়।

1828 সালে নেপাল এবং সিকিমের মধ্যে বিরোধ ব্রিটিশ সরকারের সালিশির দিকে পরিচালিত করে। ফলত 1829 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যাপটেন লয়েড দার্জিলিং-এ একটি স্যানিটোরিয়াম তৈরি করার উদ্যোগ কোম্পানির কাছে প্রদান করে। এই প্রস্তাবে তিনি দার্জিলিং-এর ভৌগোলিক অবস্থান, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে কৌশলগত দিকের গুরুত্ব উল্লেখ করেন।

তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক মেজর লয়েডের প্রস্তাবকে অনুমোদন করেন এবং 1835 সালের 23 জানুয়ারি সিকিমরাজের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁকে জমি প্রদান করতে রাজি করানো হয়। প্রথমদিকে, সিকিমরাজকে দার্জিলিং শুধুমাত্র স্যানিটোরিয়াম তৈরির স্থান হিসেবেই গৃহীত হবে, এমন প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু অপরদিক থেকে সিকিমরাজও কোম্পানির কাছে কিছু দাবি রাখেন। যেমন-সিকিমের পশ্চিম সীমানা বৃদ্ধি, কর গ্রহণকারীদের সিকিমে প্রেরণ, দারগং-কে সিকিমে প্রদান করতে হবে। কিন্তু মেজর লয়েড সিকিমরাজের এই অযৌক্তিক দাবি মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। অতঃপর তিনি 1835 সালের আগস্ট মাসে সিকিমরাজের থেকে দার্জিলিং দখল করে নেন।

অবশেষে, কোম্পানির আগ্রাসন থেকে দার্জিলিং-কে উদ্ধার করতে সিকিমরাজ ব্যর্থ হন। 1840 সালের মধ্যে দার্জিলিং-এ 60 থেকে 70টি ব্রিটিশ বসতি গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে সিকিম ও কোম্পানির সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি ঘটতে থাকে। সিকিম দার্জিলিং-এর লেপচা প্রজাদের ওপর অধিকার হারায় এবং লেপচারা তখন ব্রিটিশদের প্রজ্ঞায় পরিণত হয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading