উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রধান তিনটি
স্তম্ভ শাসন বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ । শাসন বিভাগের থেকে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ এবং ক্ষমতা, এক্তিয়ার ও কর্তৃত্বের নিরিখে আইনসভা ও বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র অবস্থান ও সক্রিয়তা এই দুটি প্রধান লক্ষ্যকে সম্মুখে রেখে পরিকল্পিত হয়েছে ভারতের বিচার ব্যবস্থা । বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যাতে অক্ষুন্ন থাকে তারপ্রয়াস প্রতিবিম্বিত হয়েছে ভারতের বিচার বিভাগের গঠনতন্ত্রে । ভারতীয় বিচারব্যবস্থার গঠন ও কার্যকারিতা সংক্রান্ত বিষয়গুলি ( ক. মৌলিক অধিকারের রক্ষক রূপে বিচার বিভাগের ভূমিকা, খ. বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, গ. বিচারবিভাগীয় পুনর্বিবেচনা, ঘ. সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের পদ্ধতি) রচিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুসরণে ।
ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় মূল বৈশিষ্ট্য
ভারতের বিচার ব্যবস্থা অখণ্ড বিচারব্যবস্থা, অর্থাৎ শাসন বিভাগ যেমন দুটি – কেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকার এবং আইনসভা যেমন দুপ্রকার – কেন্দ্রীয় আইনসভা ও রাজ্য আইনসভা , বিচারব্যবস্থার গঠন কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্য এই দুই প্রেক্ষাপটে দ্বিখন্ডিত নয় । সুপ্রিম কোর্ট, রাজ্যর হাইকোর্টসমূহ, ইউনিয়ন টেরিটোরির জুডিশিয়াল কমিশনারের আদালত, সেশন জজকোর্ট, প্রেসিডেন্সি কোর্ট ( বড় বড় শহরে ) অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্ট থেকে শুরু করে ছোট বড় সকল আদালতেই সেই অখন্ড বিচার বিভাগের বিভিন্ন অংশ ।
ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা
(ক) সংবিধানের ১২৪ (1) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট । সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি ছাড়াও আরো ২৫ জন বিচারপতি থাকেন । সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগের সময় রাষ্ট্রপতি যেমন প্রয়োজন মনে করেন সেই মতো সুপ্রিম কোর্টের এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের সাথে আলোচনা করেন । সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগের সময় রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য ।
(খ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ বছর । অসদাচরণ বা প্রমাণিত অসমর্থ্যের অভিযোগ সংসদের উভয় কক্ষে উপস্থিত ও ভোটদান কারী সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থনের পাস হলে রাষ্ট্রপতি কোন বিচারককে পদচিত্ব করতে পারেন । আজ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারপতিকে করা হয়নি ।
(গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সংখ্যা নির্ধারণের অধিকার – সংসদের ।
(ঘ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নূন্যতম যোগ্যতা
- ভারতীয় নাগরিক হতে হবে (2) তাকে কোন একটি হাইকোর্টে বা পর পর দুটি বা তার বেশি হাইকোর্টে বিচারপতি হিসাবে অন্তত পাঁচ বছর কাজ করতে হবে, অথবা (3) দশ বছর কোন একটি হাইকোর্টে বা দুটি বা তার বেশি হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসাবে আইন ব্যবস্থা করতে হবে, অথবা (4) রাষ্ট্রপতির মতানুসারে একজন বিচক্ষণ আইনগ্য হতে হবে [124(3) নং অনুচ্ছেদ]
- (ঙ) অস্থায়ী ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগ – সুপ্রিম কোর্টে অস্থায়ী ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগ করা যায় । কোরাম (আদালতের অধীন মামলা গুলির বিচারকার্য চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিচারকের সংখ্যা) না থাকলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি সম্মতির ভিত্তিতে অস্থায়ী বিচারপতিদের
প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য নিয়োগ করতে পারেন । সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসাবে কাজ করার যোগ্যতা সম্পন্ন হাইকোর্টের বিচারককেই সুপ্রিম কোর্টের অস্থায়ী বিচারক রূপে নিয়োগ করা যায় ।
(চ) সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্ষেত্র – প্রধান ধর্ম অধিকরণ এর কার্যক্ষেত্র কে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যায় যেমন –
(১) মূল অভিক্ষেত্র ( original Jurisdictions) – এমন কতগুলি মামলা আছে যেগুলি অন্য কোন আদালতে উত্থাপন করা যায় না, কেবলমাত্র সুপ্রিম কোর্টের মূল অধিক্ষেত্রেই উত্থাপিত হয় এবং নিষ্পত্তি করা যায়। এগুলি হল – (ক) কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একবার একাধিক রাজ্যের বিরোধ, (খ) কেন্দ্রীয় সরকার এবং এক বা একাধিক সরকারের সাথে বিবদমান একবার একাধিক রাজ্য সরকারের বিরোধ , (গ) একদিকে এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের সাথে অন্যদিকে একবার একাধিক রাজ্য সরকারের মতবিরোধ, (ঘ) রাষ্ট্রপতি অথবা উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিরোধ ।
(২) আপিল এলাকা (Appellate Jurisdiction) – সুপ্রিম কোর্টে চার ধরনের আপিল করা যায়, (১) ভারতীয় সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল- দেওয়ানী ফৌজদারি অথবা অন্য কোন মামলায় হাইকোর্ট যদি প্রমাণপত্র দেয় বা সুপ্রিম কোর্ট যদি মনে করে যে মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন জড়িয়ে আছে, তাহলে সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা যায়, (২) দেওয়ানী আপিল – কোন দেওয়ানী মামলায় হাইকোর্ট যদি এই মর্মে প্রমাণপত্র দেয় যে মামলাটির সঙ্গে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত তাহলে সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা যায়, (৩) ফৌজদারি আপিল – ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে তিন ধরনের আপিল করা যায় । যেমন – (ক) নিম্ন আদালতে নির্দোষ বলে প্রমাণিত কোন ব্যক্তিকে যখন হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড দেয় । (খ) নিম্ন আদালতে বিচার চলাকালীন কোন মামলাকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে হাইকোর্ট যদি কোন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং (গ) হাইকোর্ট যদি এই মর্মে প্রমাণপত্র দেয় যে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে আপিলযোগ্য, (ঘ) বিশেষ অনুমতির মাধ্যমে আপিল – ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে ভারতের যেকোনো আদালতের যে কোন রায় আদেশ ও দন্ডের বিরুদ্ধে ( সামরিক আদালত ও ট্রাইবুনাল ছাড়া) আপিল করার বিশেষ অনুমতি সুপ্রিম কোর্ট দিতে পারেন।
(৩) পরামর্শদাতা এলাকা – সংবিধানের ১৪৩ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন সংক্রান্ত প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে পারেন, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যে পরামর্শ প্রদান করবে সেটি অনুসরণ করা রাষ্ট্রপতির জন্য বাধ্যতামূলক নয়, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ রাষ্ট্রপতি মানতেও পারেন আবার নাও মানতে পারেন এবং রাষ্ট্রপতি পরামর্শ চাইলে তবে সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শ দেবে । কোন বিষয়ে, তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারে না।
(৪) মৌলিক অধিকার ভঙ্গের ক্ষেত্রে নির্দেশ, আদেশ, লেখ ইত্যাদি জারির ক্ষমতা – ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্ট বন্দী প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকার পৃচ্ছা, উৎপ্রেষণ এই পাঁচটি ধরনের নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি করতে পারে ।