১৯৮৮ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান -এর সভাপতিত্বে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারত সরকার একটি কমিশন নিয়োগ করে। এই কমিশন সুপারিশ করেছিল যে উচ্চশিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় করতে হলে শক্তিশালী ও উচ্চমানের মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়ােজন।
এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার পুনর্গঠনের জন্য সরকার ডঃ লক্ষ্মণস্বামী মুদালিয়ার-এর নেতৃত্বে ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষার উপর একটি কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন বা মুদালিয়র কমিশন নামে পরিচিত। তবে এই কমিশন কমিশন শুধুমাত্র মাধ্যমিকের দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল, শিক্ষার অন্যান্য স্তরের ক্ষেত্রে কোনাে আলােচনাই কমিশন করে নি। উপরন্তু এই কমিশন অষ্টম শ্রেণির পর যে বিশেষীকরণের সুপারিশ করেছিল তা মােটেই সাফল্য লাভ করতে পারে নি।
মুদালিয়র কমিশন -এর বিভিন্ন ত্রুটি থাকায় ভারত সরকার ১৯৬৪ সালের ১৪ই জুলাই শিক্ষার সর্বস্তরের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরামর্শদানের জন্য অপর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন ডঃ ডি. এস. কোঠারি। এই কমিশন কোঠারি কমিশন বা ভারতীয় শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত।
কোঠারি কমিশনের সদস্য:
কোঠারি কমিশনের সভাপতি ছিলেন ডঃ ডি. এস. কোঠারি । এই কমিশনের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সদস্যগণ হলেন
• ইংল্যান্ডের এইচ. এল. এলভিন (H. L. Elvin),
• মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক আর. রেভেল (R. Revell),
• রাশিয়ার অধ্যাপক এস. এ. শুমােভস্কি (S.A. Shumovsky),
• ফ্রান্সের জে. এফ. ম্যাডুগাল (J. F. Macdougall) প্রমুখেরা।
এছাড়াও ভারতীয় সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন – কে. জি. সাঈদেন, ডঃ ত্রিগুণা সেন, জে. পি. নায়েক প্রমুখেরা ।
কমিশনের বিচার্য বিষয় প্রায় দু’বছর ধরে কাজ করার পর এই কমিশন ‘শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন‘ বা ‘Education and National Development’ শিরােনামে ৬৯২ পৃষ্ঠার একটি বৃহৎ বিবরণী ১৯৬৬ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করে।
এই কমিশন সমীক্ষা চালাতে গিয়ে দেশের সামনে কতকগুলি সমস্যা লক্ষিত হয়। এইগুলি হল—খাদ্য সমস্যা, বেকারত্বের সমস্যা, জাতীয় সংহতির সমস্যা, মূল্যবােধের সমস্যা ইত্যাদি। অথচ ভারতের শ্রেণিকক্ষেই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হচ্ছে। তাই কমিশন শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসাবে প্রয়ােগ করার জন্য শিক্ষাবিপ্লব সৃষ্টি করার কথা বলে।
কমিশন তার প্রতিবেদনের শুরুতেই উল্লেখ করে যে, “ভারতের ভাগ্য তার শ্রেণিকক্ষেই নির্মিত
হচ্ছে।” তাই শিক্ষাকে প্রথম থেকেই এমনভাবে পরিচালিত করতে হবে, যাতে এর মাধ্যমে জনগণের
আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষাই হল প্রধান হাতিয়ার।
এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কমিশন শিক্ষার ক্ষেত্রে কতকগুলি এলাকা চিহ্নিত করে। এইগুলি
হল-
• বিদ্যালয় শিক্ষা,
• উচ্চশিক্ষা,
• প্রযুক্তিমূলক শিক্ষা,
• কৃষিশিক্ষা,
• বয়স্ক শিক্ষা,
• শিক্ষক-শিক্ষণ,
• ছাত্রকল্যাণ,
• জনশক্তি,
• পরিকল্পনা,
• শিক্ষা-পরিশাসন ইত্যাদি।
এই কমিশন শিক্ষার ক্ষেত্রে সবদিকগুলি বিবেচনা করে কতগুলি সুপারিশ করে। এই সুপারিশগুলি হল
• (১) ৭ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা,
• (২) দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকলের জন্য একই ধরনের সাধারণ পাঠক্রম,
• (৩) উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন,
• (৪) কারিগরি শিক্ষায় ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা আনয়ন,
• (৫) শিক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পাদন,
• (৬) দশম শ্রেণির পর বিশেষীকরণ ইত্যাদি।
কমিশনের রিপোর্টের ভাগ:
ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের রিপাের্টটি চারটি খণ্ড বা ভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলি হল —
• প্রথম খণ্ডে ছিল শিক্ষাসংক্রান্ত সাধারণ সমস্যা সম্পর্কে আলােচনা,
• দ্বিতীয় খণ্ডে ছিল বিভিন্ন স্তর ও পর্যায়ের শিক্ষা সম্পর্কে আলােচনা,
• তৃতীয় খণ্ডে ছিল শিক্ষা পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ সম্পর্কিত আলােচনা এবং
• চতুর্থ খণ্ডে ছিল শিক্ষাসংক্রান্ত কয়েকটি বিবরণ ও দলিলপত্র নিয়ে আলােচনা।
কমিশনের নীতিসমূহ:
কোঠারি কমিশন তার সুপারিশগুলো ছাড়াও কয়েকটি মৌলিক নীতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। এই সমস্ত নীতিগুলি হল –
• (১) শিক্ষাকে উৎপাদনের সঙ্গে সংযােজন,
• (২) শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষভাবে সমাজ সেবায় অংশগ্রহণ,
• (৩) মাধ্যমিক শিক্ষাকে বৃত্তিমুখীকরণ,
• (৪) শিক্ষার ক্ষেত্রে বাছাই নীতি (Selective Approach) অনুসরণ,
• (৫) অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জনশক্তি পরিকল্পনা (Man Power Planning) গ্রহণ,
• (৬) শিক্ষায় সমসুযােগের নীতি (Principle of Equal Opportunity) অনুসরণ ইত্যাদি।
শিক্ষাকাঠামো:
ভারতীয় শিক্ষা কমিশন প্রদত্ত শিক্ষাকাঠামােটি হল ১০ বছরের মাধ্যমিক, ২ বছরের উচ্চমাধ্যমিক, ৩ বছরের স্নাতক স্তর এবং ২ বছরের স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা।
শিক্ষাস্তর:
কোঠারি কমিশনের শিক্ষাকাঠামােয় চারটি শিক্ষাস্তরের উল্লেখ ছিল।এগুলি হল –
• প্রাক প্রাথমিক স্তর,
• প্রাথমিক স্তর- নিম্নপ্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক,
• মাধ্যমিক স্তর- নিম্নমাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং
• বিশ্ববিদ্যালয় স্তর- স্নাতক স্তর ও স্নাতকোত্তর স্তর।